>

যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলরের লিড সনদে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার পুরস্কার জিতে নেয় বাংলাদেশের প্লামি ফ্যাশন লিমিটেড। সনদের মোট ১১০ নম্বরের মধ্যে ৯২ নম্বর পায় প্রতিষ্ঠানটি। পোশাক শিল্প খাতে এটি সবচেয়ে বড় সম্মান। এই সবুজ কারখানার স্থাপত্য নকশা করেছেন বাংলাদেশের স্থপতি মেহেরুন ফারজানা
অগ্নিকাণ্ড, ভবনধসের মতো একের পর এক নেতিবাচক খবরে বিশ্ব পোশাকবাজারে যখন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দুর্বল, ঠিক তখন বড় একটি প্রাপ্তির খবর আসে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলরের লিড সনদে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার পুরস্কার জিতে নেয় বাংলাদেশের প্লামি ফ্যাশন লিমিটেড। সনদের মোট ১১০ নম্বরের মধ্যে ৯২ নম্বর পায় প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে ৯০ নম্বর পেয়েছিল বাংলাদেশেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও।
পোশাক শিল্প খাতে এটিই সবচেয়ে বড় সম্মান। আর এই সবুজ কারখানার স্থাপত্য নকশার পেছনে আছেন বাংলাদেশের স্থপতি মেহেরুন ফারজানা।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের উত্তর নরসিংহপুরে প্রায় সাড়ে পাঁচ একর জায়গা নিয়ে শুরু হয় প্লামি ফ্যাশন লিমিটেডের কাজ। কারখানাটির নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন স্থপতি মেহেরুন ফারজানা। তাঁর নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের নাম আর্কভিজ। প্লামি ফ্যাশন লিমিটেডের কাজের অভিজ্ঞতাটা একেবারেই নতুন ছিল মেহেরুনের কাছে। সঙ্গে ছিল প্লাটিনাম সনদ অর্জনের চ্যালেঞ্জ। তাঁর নেতৃত্বে ছয়জনের একটি দল নিয়ে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্লামি ফ্যাশনের কাজ শুরু হয়। চলতি বছরের মে মাসে শেষ হয় নির্মাণকাজ। কারখানার স্থাপনা থেকে শুরু করে উৎপাদন পর্যন্ত প্রতিটি বিষয় যাতে পরিবেশবান্ধব হয়, এটা প্লাটিনাম সনদ জেতার পূর্বশর্ত। তাই সাড়ে পাঁচ একর জায়গার এই প্রতিষ্ঠানটিতে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল থেকেই ৬৫ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা হয়। ফাঁকা রাখা হয় কারখানার ৫২ ভাগ জমি। দিনের আলোর ব্যবহারেই যাতে কাজ সম্পন্ন করা যায়, এভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে ভবনের ওপরের অংশ। ‘রিসাইক্লিং’ পদ্ধতিতে করা হচ্ছে কারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ভবনজুড়ে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা তো রাখা আছেই, তার পাশাপাশি আছে পুকুর। আরও আছে লাইফস্টাইল সেন্টার, যেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণকক্ষ, চিকিৎসা সহায়তাকেন্দ্র, পাশাপাশি ডে কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থাও থাকছে বলে জানালেন মেহেরুন।
মেহেরুন ফারজানার ছোটবেলা কেটেছে ময়মনসিংহ শহরে। ভালোবাসতেন ছবি আঁকতে। ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ১৯৯৬ সাল থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৮ সালে সরকারি মমিনুন্নেছা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায়। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর স্থপতি হিসেবে কাজ করেন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে। সব সময় ভেতর থেকে দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। যেখানে তাঁর নিজস্ব কল্পনা ডানা মেলে ছড়াবে সৃষ্টির গৌরব। এই ভাবনা থেকেই আর্কভিজের যাত্রা শুরু।
মেহেরুনের স্বামী কম্পিউটার প্রকৌশলী শামসুল আরেফীনের অনুপ্রেরণা ছিল অসামান্য। ‘যেহেতু এই ধরনের কাজের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাই ছিল না আমাদের, তাই আর্কভিজ দলের কাছে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি প্লামি ফ্যাশন এক স্বপ্নের বাস্তবায়ন।’ প্লামি ফ্যাশনের সফলতার পর নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও বর্তমানে সাভার, নরসিংদী আর চট্টগ্রামে সাতটি ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি’ বা সবুজ কারখানার কাজ শুরু করেছে আর্কভিজ।
প্লামি ফ্যাশন কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক জানালেন, যেদিন রানা প্লাজা ভেঙে পড়ল, ঠিক সেই সময়ে তিনি কাঠমান্ডু যাচ্ছিলেন। যখন কাঠমান্ডু পৌঁছালেন, তখন উড়োজাহাজের এক যাত্রী জানালেন, এই মুহূর্তে দেশে থাকাটাই তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ হতো। বিষয়টি খুব ভাবাল ফজলুল হককে। দেশে ফিরে তিনি এমন একটি কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা নেন, যেটা বিশ্বব্যাপী পাল্টে দিতে পারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। এভাবেই শুরু হয় প্লামি ফ্যাশন কারখানার কাজ। এদিকে এই ধরনের প্রকল্পে কাজের কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না স্থপতি মেহেরুন ফারজানার, তাই প্রথম দিকে একটু দ্বিধান্বিতই ছিলেন ফজলুল হক। তবে ফজলুল হকই জানালেন, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি নির্মাণে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলে হয়তো গৎবাঁধা নির্মাণেই স্থান পেত প্লামি ফ্যাশন। আর এই কাজ না করার অভিজ্ঞতাই মেহেরুনকে একটি বিশ্ব মানের প্রকল্প নির্মাণে সহায়তা করেছে।