স্মৃতি

লারা ফাউন্ডেশনে চার দিন

ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সঙ্গে সামনাসামনি আমার দেখা হওয়াটা কিছুটা ঘটনাচক্রে। হাঙর নদী গ্রেনেড পড়ার পর থেকেই আমার তাঁকে দেখার ইচ্ছা ছিল বহু দিনের। আমি উইমেন ফর উইমেনে (একটি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান) কাজ করি। একটা সভায় দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। লারার বিমান দুর্ঘটনার কথাটা আগে থেকেই জানতাম। কাছে গিয়ে তাঁর কাজ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানলাম।

বরগুনার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল বামনার ডৌয়াতলা গ্রামে ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। মেয়ের স্মৃতি ধরে রেখেছেন। সেলিনা হোসেনের স্বামী আনোয়ার হোসেন খানের পৈতৃক জমিতে স্থাপিত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। ‘দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার প্রান্তিক নারী-মেয়ে-শিশু ও সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং বেকার সমস্যা নিরসনে সর্বাত্মক সহায়তা দান’—এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

দুস্থ ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল আর কলেজ করেছেন, মেয়েদের থাকার জন্য একটা হোস্টেলও আছে। খেলার মাঠ আছে। শুনে মনে হলো, আমি তো নিজে থেকে কোনো বড় কাজই করতে পারব না। আমার তেমন সামর্থ্যও নাই। তবে কারও মহৎ কাজে কিছুটা সাহায্য তো করতে পারি। জিজ্ঞেস করলাম, আমি কিছু সহায়তা করলে আপনি নেবেন? উনি হেসে বললেন অবশ্যই।

আমি কয়েক ব্যাগ পুরোনো জামা-কাপড়, শাড়ি, গরম কাপড় এবং চেকটা লিখে এনেছিলাম। তাঁর হাতে দিলাম সঠিকভাবে নামটা লেখার জন্য। উনি বড় করে লিখলেন, ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন। একটা মহৎ কাজে সামান্য একটু হলেও অংশ নিতে পারছি, এটা ভেবে খুব ভালো লাগল। সেলিনা বললেন, কিন্তু শুধু টাকা দিয়েই শেষ করবেন? যাবেন না আমাদের কাজটা দেখতে? ঘুরতে, বেড়াতে আমার সব সময় খুব ভালো লাগে। তাই সঙ্গে সঙ্গেই বললাম, অবশ্যই যাব যখন আপনি নিয়ে যাবেন।

এরপর হঠাৎ করেই সেলিনা হোসেন একদিন আমাকে ফোন করলেন, স্বাধীনতা দিবস পালন উপলক্ষে তাঁরা ডৌয়াতলায় যাবেন। আমি যেন তৈরি থাকি। চার-পাঁচ দিন থাকতে হবে। আমার মেয়েদের জানাতে ওরা প্রথমে বেশ আপত্তি করল। আমি বেশিক্ষণ হাঁটতে পারি না, রাতের ওষুধ খেতে অনেক সময়েই ভুলে যাই, খাওয়াতে অনেক বাধানিষেধ আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বয়স পঁচাত্তর পার হয়ে গেলে সাধারণ যে অসুবিধা থাকে তাই আর কি। কিন্তু আমার বিশেষ ইচ্ছা দেখে ওরা আর আপত্তি করল না। ঠিক হলো, এ বছরের ২৭ মার্চ তিনি আমাকে নিয়ে রওনা হবেন লঞ্চে। আনোয়ার সাহেব আগে গিয়ে সব ব্যবস্থা করবেন।

২৭ মার্চ সেলিনা হোসেনের সঙ্গে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালের দিকে রওনা হয়ে গেলাম একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। আমাদের লঞ্চ ছাড়ে রাত আটটায়। অন্ধকার অন্ধকার ভোরে চলতে বেশ ভালোই লাগছিল। ঠান্ডা বাতাস। যদিও শীতকাল না, তবু দেখলাম বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে ধোঁয়ার মতো কুয়াশার আস্তরণ। পাখিদের কিচিরমিচির। মাঝে মাঝেই গ্রাম পড়ছে পথে। কিছু লোক ঘুম থেকে উঠে আলস চোখে তাকিয়ে দাঁত মাজছে। দু-একটা চায়ের দোকানের ঝাঁপ খুলছে। আস্তে আস্তে রোদ উঠে গেল। পথে আমরা একটা নতুন ব্রিজ পার হলাম। বামনার ডৌয়াতলা গ্রামে পৌঁছালাম সকাল সাড়ে সাতটায়।

 নাশতা খেয়ে একটু হেঁটে গেট দিয়ে বের হলে স্কুলের গেটে ঢুকতে হয়। সামনে দেখলাম একটু উঁচু ডায়াস। সেলিনার সঙ্গে আমিও উঠলাম। আনোয়ার সাহেব ছিলেন আরেকটি ডায়াসে। ছেলে আর মেয়েরা লাইন ধরে সুন্দরভাবে স্যালুট করে মার্চপাস্ট করল। সবাই একই সঙ্গে গাইল আমাদের জাতীয় সংগীত। হলের ভেতরে বেশ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি যেমন ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ স্থানীয় কলেজের প্রিন্সিপাল, স্কুলের হেডমাস্টারসহ অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।

সমগ্র অনুষ্ঠান খুব সুন্দরভাবে পরিচালিত হলো। ছেলেমেয়েরা গাইল ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’সহ অনেক গান। স্বাগত ভাষণের পর সবাই কিছু কিছু বক্তব্য দিলেন। প্রায় দুইটার দিকে অনুষ্ঠান শেষ হলো। সেলিনা ও আনোয়ার সাহেবের সঙ্গে মেয়েদের হোস্টেল, স্কুল, কলেজ ও শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ঘুরে দেখলাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় দোতলা হোস্টেলে ৪০ জন কর্মজীবী নারী-কিশোরী, ছাত্রীর থাকার ব্যবস্থা আছে এখানে। স্কুল-কলেজের স্থাপনা নির্মাণে সরকারি সহায়তা নেওয়া হয়েছে। তবে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়েছে ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষক, সদস্য ও ব্যক্তিদের অনুদান ও অবদানে। সবকিছু দেখে আমার মনে হয়েছে, এই উদ্যোগে সত্যি অনেক মানুষ এগিয়ে এসেছেন। প্রত্যন্ত একটি গ্রামকে আলোকিত করতে সেলিনা-আনোয়ার সব রকমের সহযোগিতা পাচ্ছেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। প্রায় প্রত্যেকেই তাঁদের বাড়িতে খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। এলাকার মানুষ দেখলাম তাঁদের দুজনকে খুবই পছন্দ করেন। রাতে তাঁদের সঙ্গেই একজন চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে গেলাম খেতে। প্রচুর আয়োজন।

প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দাওয়াত খেতে যেতে হতো এবং রাতেও। চেষ্টা করেও বাদ দিতে পারতাম না। বলতাম, আমার খাওয়াতে অনেক বাধানিষেধ আছে। কিন্তু দমাতে পারতাম না তাঁদের আন্তরিকতাকে।

বরগুনার গৌরীচন্না ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জমকালো অনুষ্ঠান, ছেলেমেয়েরা নাচল-গাইল। খুবই ভালো এদের পরিবেশনা। শুনলাম, এদের মধ্যে একটি ছেলে নাচে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। ওখান থেকেই দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা হয়ে গেলাম লঞ্চঘাটের উদ্দেশে। খুব সকালে পৌঁছে গেলাম সদরঘাটে। আবার সেই পরিচিত পুরোনো ঢাকা!

লেখক: বিসিকের সাবেক পরিচালক, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচি (উইডিপি)

ভাইস প্রেসিডেন্ট, উইমেন ফর উইমেন