‘শ্বশুর বাড়ি মধুর হাঁড়ি’—প্রবাদটি আমাদের সমাজে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত আছে। অনেক জামাতাই এ মধুর হাঁড়িকে অন্যভাবে ব্যবহার করতে চান এবং করেও থাকেন। এ নিয়ে পারিবারিক জীবনে নেমে আসে নানা জটিলতা ও অশান্তি। কখনো কখনো অশান্তি গড়ায় মামলা–মোকদ্দমা পর্যন্ত। যৌতুক–সংক্রান্ত যত অপরাধের ঘটনা ঘটে, তা এই ‘মধুর হাঁড়ি’ নিয়েই। অথচ শ্বশুরবাড়ির কোনো কিছুর ওপর দাবি করার আইনত অধিকার জামাতার নেই।
কেন অপরাধ?
বিয়ের সময় ছেলেপক্ষ কোনোভাবেই শ্বশুরবাড়ি থেকে কোনো কিছু দাবি করতে পারবে না। এ দাবির বিনিময়ে বিয়ে করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা আইনত অপরাধ। এটি যৌতুকের পর্যায়ে পড়ে। এমনকি বিয়ের পরে অন্যায় দাবিদাওয়া করাও চলবে না। শুধু যে ছেলেপক্ষ দাবি করলেই অন্যায় হবে তা নয়, মেয়েপক্ষও মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কাছ থেকে কিছু দাবি করতে পারবে না। এটিও যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে আইন অনুযায়ী। শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তিতে মেয়ের স্বামীর কোনো অধিকার নেই।
শ্বশুর বা শাশুড়ি মারা গেলে মুসলিম আইন অনুযায়ী তার ওয়ারিশদের ওপর এ সম্পত্তি বর্তায়। এ সম্পত্তির মালিকানা মেয়ে পাবে কিন্তু কোনোভাবেই মেয়ের স্বামী মালিক হবেন না। তবে স্ত্রী মারা গেলে স্ত্রীর সম্পত্তির ভাগ তার স্বামী পাবে। স্ত্রী জীবিত থাকা অবস্থায় নয়।
এখানে জেনে রাখা ভালো, শ্বশুর বা শাশুড়ির সম্পত্তির ভাগ স্ত্রী পাওয়ার পর এ সম্পত্তি তখন স্ত্রীর নিজস্ব সম্পত্তি হবে। এটিকে আর শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি বলার সুযোগ নেই। স্ত্রী তার শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু আইনি অধিকার দাবি করতে পারে। যেমন স্বামী যদি জীবিত অবস্থায় তার দেনমোহর পরিশোধ না করে থাকেন, তবে স্বামীর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে আদায় করতে পারবেন। আবার স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণও দাবি করা যাবে। এমনকি শ্বশুর বেঁচে থাকলে তার কাছেও দাবি করা যাবে। স্বামী মারা গেলে স্বামীর সম্পত্তির ভাগও পাবেন স্ত্রী।
অনেক সময় দেখা যায়, অনেক স্বামী বা স্বামীর আত্মীয়স্বজন স্ত্রী বা স্ত্রীর মা–বাবার কাছে অন্যায় দাবি করতে থাকেন, বিশেষ করে টাকাপয়সাসহ অন্য জিনিসপত্র। এ নিয়ে স্ত্রীর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার ঘটনাও ঘটে। টাকাপয়সা বা অন্যান্য জিনিসের জন্য চাপ দেওয়া পারিবারিক নির্যাতনের শামিল। এ রকম পরিস্থিতির শিকার হলে স্ত্রী আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলে যৌতুক নিরোধ আইন বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আশ্রয় নেওয়া যাবে। স্ত্রীসহ অনেক জামাতা শ্বশুর–শাশুড়ির সঙ্গে একত্রে বসবাস করে থাকেন। একসঙ্গে থাকলে জামাতা পুত্রের মতো আদর যত্ন পেতে পারে কিন্তু সম্পত্তির ভাগ পাবে না।
কখন শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি ভোগ করা যাবে?
কোনো শ্বশুর বা শাশুড়ি যদি স্বেচ্ছায় তাঁদের মায়ের স্বামী অর্থাৎ জামাইকে সম্পত্তি দান করে দিয়ে থাকেন, এবং এ দান যদি আইনগতভাবে সম্পাদন করা হয়, কেবল সে ক্ষেত্রেই শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি নিজের সম্পত্তি হিসেবে ভোগ করা যাবে। অন্যথায় কোনোভাবেই নয়। আর শ্বশুরবাড়ি থেকে যদি কোনো কিছু উপহার দেওয়া হয়, তাহলে সেটিও ভোগ করা যাবে। তবে শ্বশুর–শাশুড়িকে যত্নআত্তি ও ভরণপোষণ করা কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব। সে ক্ষেত্রে কর্মক্ষম স্ত্রীকে তার মা–বাবার ভরণপোষণও দেওয়ার বিধান আইনে আছে। শ্বশুর–শাশুড়িকে ভরণপোষণ দিতে স্বামী বা স্ত্রী কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট