২০১১ সাল। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ। টিকিট নিয়ে আমাদের কাণ্ডকীর্তিগুলো মনে আছে? দুই দিন আগে থেকে কেউ কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফুটপাতে বিছানা-বালিশ পেতে অনেকে ব্যাংকের সামনেই রাত কাটিয়েছেন। ‘বেলাইনে’ লাইনে ঢুকতে গিয়ে কারও কারও পুলিশি লাঠির ‘সোহাগ’ও জুটেছে! ক্রিকেট—সে যে টুর্নামেন্টই হোক, টিকিট আমাদের চাই! খেলার আগে বহু আরাধ্য যে টিকিট, খেলা শেষে সেই টিকিটখানা কি করেছেন, বলুন তো? জয়ের আনন্দে বাতাসে উড়িয়েছেন, নয়তো পরাজয়ের ক্লেশে কোন ফাঁকে হাত গলে পড়ে গেছে, টেরও পাননি। কেউ কেউ নিশ্চয়ই টিকিট সংগ্রহেও রেখেছেন। জুনায়েদ মোর্শেদের সংগৃহীত টিকিটের সংখ্যাটা শুনলে তাঁরা বোধহয় লজ্জাই পাবেন!বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কর্মরত জুনায়েদ মোর্শেদ পাইকার। জুনায়েদের উত্তরার বাসায় কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। ক্রিকেট ম্যাচের টিকিটই যে শুধু সংগ্রহ করেন তা নয়, টিকিটের গায়ে খেলোয়াড়দের অটোগ্রাফ নিয়ে খেলার আগে যে টিকিট ‘দুর্মূল্য’, খেলা শেষে তাকে ‘অমূল্য’ করে রাখেন! জুনায়েদের নেশাটা মূলত অটোগ্রাফ সংগ্রহের। সাদা কাগজে অটোগ্রাফ নিতে নিতে একসময় মনে হলো, ‘নাহ্, ঠিক মজা হচ্ছে না!’ একেকটা ম্যাচের টিকিটের গায়ে সেই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের সই সংগ্রহে রাখতে শুরু করলেন। খেলা দেখতে যান বা না যান, টিকিটটা তাঁর চাই! জুনায়েদ বলছিলেন, ‘বলা তো যায় না, কোন ম্যাচে কে কী কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। তাই আগে থেকেই টিকিটের বন্দোবস্ত করে রাখি।’ তাঁর প্রিয় খেলোয়াড় মোহাম্মদ আশরাফুল। আশরাফুল যে কয়টা ম্যাচে ‘আশরাফুলের’ মতো খেলেছেন, সব কয়টা ম্যাচের টিকিটের গায়েই তাঁর সই নেওয়া আছে। সই নিতে নিতেই আশরাফুলের সঙ্গে ভালো পরিচয় হয়েছে। জুনায়েদ বললেন, ‘আমার অটোগ্রাফ সংগ্রহের পেছনে আশরাফুল অনেক সহযোগিতা করেছেন। বিশ্বকাপের সময় তিনি আমাকে অনেক খেলোয়াড়ের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে দিয়েছেন।’ কোনো কোনো টিকিটে আবার পুরো দলের সবার সই নেওয়া আছে। বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের টিকিটের গায়ে সেই টেস্টে পাঁচ উইকেট নেওয়া নাইমুর রহমান দুর্জয়ের অটোগ্রাফ নিয়েছেন। ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ ও নিল ম্যাকেঞ্জি ওপেনিং জুটিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে ৪১৫ রান করেছিলেন। সেই টেস্টের টিকিটে এই দুই ক্রিকেটারের অটোগ্রাফও নিয়েছেন জুনায়েদ। এ রকম বহু সংগ্রহ তাঁর। ২০১১ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, যেদিন থেকে ৫৮ সংখ্যাটা অপ্রিয় হলো এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের! কাকতালীয়ভাবে পরদিন ৫ থেকে ৭ মার্চ নিজের সংগ্রহ নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন জুনায়েদ। তিনি বললেন, ‘প্রদর্শনী উদ্বোধন করেছিলেন হাবিবুল বাশার। সে সময় সবার মন খারাপ ছিল। তবু পুরোনো ঐতিহাসিক খেলাগুলোর টিকিট দেখে দর্শনার্থীদের কষ্টে কিছুটা হলেও প্রলেপ পড়েছে। সবাই ভাবতে পেরেছে, আমরা এখনো ফুরিয়ে যাইনি।’শুধু টিকিট নয়, অটোগ্রাফ নিতে এঁটেছেন আরও নিত্যনতুন বুদ্ধি। ইন্টারনেট থেকে ক্রিকেটারদের আকর্ষণীয় সব পোস্টার ডাউনলোড করে তাতে অটোগ্রাফ নিয়েছেন। তবে আর দশজন অটোগ্রাফ শিকারির মতো ক্রিকেটার দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন না জুনায়েদ। পাকা শিকারির মতো অটোগ্রাফ নেওয়ার আগেই রীতিমতো ‘নীলনকশা’ আঁকেন! আইসিসির সফরসূচিতে চোখ রাখেন, কবে কোন ক্রিকেটার বাংলাদেশে আসছেন, সেটার খোঁজ রাখতে। বিদেশি ক্রিকেটাররা বাংলাদেশে এলে সাধারণত তাঁদের ঠাঁই হয় রূপসী বাংলা হোটেলে। অটোগ্রাফ নেওয়ার আগের দিন জুনায়েদ রূপসী বাংলায় ‘রেকি’ করতে যান। কোথায় দাঁড়াবেন, কোথায় অটোগ্রাফ নেবেন, পোস্টার, মার্কার—সব আগে থেকে ঠিক করা থাকে। সময়মতো ক্রিকেটারদের কাছে পেলেও সাবধানে ও বিনয়ের সঙ্গে অটোগ্রাফ নেন জুনায়েদ, যেন ক্রিকেটার বা নিরাপত্তারক্ষীদের চক্ষুশূল হতে না হয়! এ ছাড়া খেলার মাঠ, অনুশীলনের মাঠ এমনকি ক্রিকেটাররা যেখানে নাশতা করেন, সেখানেও থাকে তাঁর শিকারি নজর! কখনো কখনো ক্রিকেটারদের অটোগ্রাফ নিতে রূপসী বাংলা হোটেলে সকালে নাশতাও করেন। বেশ একটা খরচাপাতির ব্যাপার—সেটাও খুব একটা গায়ে মাখেন না।অটোগ্রাফ নেওয়ার পাশাপাশি ক্রিকেটারদের সঙ্গে ছবিও তোলেন জুনায়েদ। অনেক বিখ্যাত ক্রিকেটারের সঙ্গে তোলা ছবি সংগ্রহে আছে তাঁর। এ কাজেও ঝামেলা আছে। ছবি তুলে দিতে বন্ধুদের কাউকে সঙ্গে নিলে তারাই ক্রিকেটারদের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে যায়। তাই আলোকচিত্রী হিসেবে জুনায়েদ এমন একজনকে খুঁজে নেন, যার ক্রিকেটারদের সঙ্গে ছবি তোলায় কোনো আগ্রহ নেই। সেই আলোকচিত্রী আর কেউ নন, জুনায়েদের সহধর্মিণী সুমাইয়া আফরিন! সুমাইয়া বলছিলেন, ‘ক্রিকেট আমি অত বুঝি না। আমার অত আগ্রহও নেই। ওর আগ্রহ আছে বলেই ওর সংগ্রহের জিনিসগুলো যত্ন করে রাখি। এটুকু অন্তত বুঝি, এগুলো খুবই দুর্লভ।’আরও আছে! বিখ্যাত ক্রিকেটারদের ব্যাটের অনুকরণে নিজে ডিজাইন করে ব্যাট তৈরি করেন জুনায়েদ। সেই ব্যাটের গায়ে অটোগ্রাফ নেন! খেলা শেষ হলেই স্ট্যাম্প উঠিয়ে নিয়ে যান ক্রিকেটাররা, আর লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন জুনায়েদ। সেই স্ট্যাম্প তাঁর হাত পর্যন্ত না পৌঁছলেও, ছবি দেখে দেখে রেপ্লিকা তৈরি করে সংগ্রহে রাখেন জুনায়েদ!বাংলাদেশের ক্রিকেট-ইতিহাসের বহু দুর্লভ সংগ্রহ আছে জুনায়েদের কাছে। তবে সবচেয়ে দুর্লভ বোধহয় এমন একজন ক্রিকেটারের অটোগ্রাফ, যাঁর অটোগ্রাফ এখন আর শত সাধনায়ও কেউ সংগ্রহ করতে পারবে না; তিনি প্রয়াত ক্রিকেটার—মানজারুল ইসলাম!