চলতি রস

সমগ্র রস+আলো পাঁচ শ

অাঁকা: সাদাত
অাঁকা: সাদাত

এক হাজার টাকার নোট বের হওয়ার পর থেকে ৫০০ সংখ্যাটার গ্ল্যামার কমে গেছে। ফলে রস+আলোর ৫০০ সংখ্যা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। এত দিনে মাত্র ৫০০? কিন্তু ৫০০ সংখ্যাটাকে ছোট করে দেখবেন না। ওয়ানডেতে এখনো ৫০০ করতে পারেনি কোনো দল। আর ৫০০ রান? সে তো করেছিলেন ব্রায়ান লারা, তাও ফার্স্টক্লাস ম্যাচে। ফলে রস+আলোর ৫০০ রানও কম না।
প্রথম সংখ্যা থেকে ৫০০তম সংখ্যা পর্যন্ত অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছে রস+আলো। প্রথম ইনিংস শুরু হয়েছিল সিমু নাসেরের হাত ধরে। দ্বিতীয় ইনিংসে রস+আলোর হাল ধরেছেন মাহফুজ রহমান। শুরু থেকেই রস+আলোর পাতা লেখা-আঁকায় ভরিয়েছেন অসংখ্য আইডিয়াবাজ-কার্টুনিস্ট। সবার নাম বললে চাকরি (জায়গা) থাকবে না। তবে সবাই এখন স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফল (যদিও প্রত্যেকের বাবা-মা ভাবেন উল্টোটা)। কিন্তু রস+আলোর মতো একটা রম্য ক্রোড়পত্র কীভাবে ৫০০ সংখ্যা বের করে ফেলল? এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই আপনার মাথায় উঁকি দিচ্ছে। দাঁড়ান, বলছি।
সোমবার রস+আলো বের হওয়ার পর ‘আমার লেখা ছাপলেন না কেন?’ অথবা ‘লেখা ছাপলেন, কিন্তু আসল লাইনটাই তো ফেলে দিলেন ভাই’—এ ধরনের ফোন ধরেই মাথা গরম হয়ে যায় সম্পাদকের। মাথা ঠান্ডা করতে মঙ্গলবার ছুটি থাকে তাঁর। মোবাইল ফোন বন্ধ করে দীর্ঘ ঘুম দেন তিনি। ঘুম ভাঙে বুধবার সকালে। অফিসে এসেই মিটিং ডাকেন। যদিও প্রতি বুধবার মিটিং হবে এটা অলিখিত নিয়ম, আলাদাভাবে না ডাকলেও চলে। তারপরও তিনি সম্পাদক, ডাকাডাকি না করলে চলবে কেন? মনে রাখবেন, কাক ও সম্পাদক এই দুই প্রজাতি কারণ ছাড়াই ডাকতে পারে। সম্পাদকের আরও একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তাঁকে সব সময় ব্যস্ততার ভান করতে হয়। বোঝাতে হয় তাঁর সময় খুব কম। আপনি অফিসে এলে দেখবেন, অধিকাংশ বিভাগীয় সম্পাদক তাঁদের ডেস্কে নিজের ভিজিটিং কার্ড ঝুলিয়ে রেখেছেন। এমনিতে এটাকে খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে, কিন্তু এর ভেতরে রয়েছে নিগূঢ় অর্থ। তাঁরা বোঝাতে চান, কাজের এত চাপ যে তাঁরা নিজের নামটাও ভুলে যান অনেক সময়। তাঁদের মনে হয়, ‘আমি কে? আমি এখানে কেন? কী আমার পরিচয়?’ তখন ভিজিটিং কার্ডই একমাত্র সম্বল।

তো ব্যস্ত সম্পাদক এখন আর কাউকে সরাসরি মিটিংয়ের জন্য ডাকেন না। রস+আলোর গোপন গ্রুপে (যে গ্রুপ এতই গোপন যে সবাই এটার কথা জানে) পোস্ট দেন ‘আজকে আসো। জরুরি মিটিং আছে।’
রস+আলো গ্রুপের সদস্যরা লাইক-কমেন্ট করে অ্যাকটিভ থাকে পোস্টটায়। তাঁদের কমেন্টগুলো এ রকম—
১. আসতেছি ভাই। (এর মানে সে আর আসবে না।)
২. আমি অন দ্য ওয়ে। প্রায় চলে আসছি। (আসবে, কিন্তু সবার শেষে।)
৩. খাবারের অর্ডার দেন, ভাই। দুপুরে খাই নাই। (এসে খেয়ে চলে যাবে।)
৪. সরি ভাই, আজ আসতে পারছি না। মিড আছে (পড়ুন ডেট আছে)।
কমেন্টগুলো দেখে চিন্তার ভাঁজ পড়ে সম্পাদকের কপালে। কিন্তু তিনি কর্তৃপক্ষের মতো নীরব ভূমিকা পালন করেন। তিনটায় মিটিং শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু মিটিংরুমে রস+আলো বাহিনীর কারও উপস্থিতি না দেখে হতাশ হয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে যান সম্পাদক। ফিচার বিভাগের অন্য কাজে মনোযোগ দেন তিনি।
৪টা বাজলে এক-এক করে আসতে থাকেন রস+আলোর সদস্যরা। কুশল বিনিময় শেষে শুরু হয় অজুহাত বিনিময়, ‘ভাই, রাস্তায় কী বিশাল জ্যাম! এত জ্যাম কোনো দিন দেখি নাই। ২০ মিনিট ধরে হতভম্ব হয়ে জ্যাম দেখলাম। তারপর ৫ মিনিট হেঁটে চলে আসলাম।’
সম্পাদক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘তোমরা মিটিং শুরু করো। কী কী করা যায় ভাব। আমি আসছি।’
রস+আলোর সদস্যরা মিটিংরুমে যান। এসি ছেড়ে গা এলিয়ে বসেন। সর্বকনিষ্ঠ সদস্যকে আদেশ দেন, ‘যাও তো, মামুন ভাইকে চায়ের কথা বলো।’ কনিষ্ঠ সদস্য অত্যন্ত আগ্রহের (এই আগ্রহ পরবর্তী কনিষ্ঠ সদস্য আসা পর্যন্ত বহাল থাকে) সঙ্গে ক্যানটিনে গিয়ে চায়ের কথা বলে মামুন ভাইকে।
কিছুক্ষণ পর সম্পাদক মিটিংরুমে এসে দেখেন জমজমাট আড্ডা দিচ্ছে সবাই। সামনে শূন্য চায়ের মগ। কয়েকটা প্লেট (দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলে, এখানে কিছুক্ষণ আগেও কয়েক হালি বিস্কুট ছিল, এখন গুঁড়াটাও অবশিষ্ট নেই)। চেয়ারে বসতে বসতে তিনি বলেন, ‘কী কী ভাবলা, বলো। কী নিয়ে সংখ্যা হবে?’
আইডিয়াবাজরা হাতে তালি মেরে বলে, ‘ভাই, কোনো চিন্তা করবেন না। দুইটা সংখ্যার ম্যাটার রেডি করে ফেলছি আমরা। ফাটাফাটি সব আইডিয়া।’
‘নোট করছ?’
‘না, ভাই। কলম তো আনি নাই। সব মাথায় আছে। একদম রেডি। এখন যদি একটু কফির কথা বলেন, তাইলে ভালো হয়। কফিটা খেয়েই ধুপধাপ নামায় ফেলব আইডিয়াগুলো।’
‘এইমাত্র না চা খাইলা?’
‘চা? এগুলা আমরা খাই নাই, ভাই! বিশ্বাস করেন! আমাদের আগে যারা ছিল, তারা খাইছে বোধ হয়। আমরা আপনাকে ছাড়া চা খাব? এটা হয় কখনো?’
‘বলো তাহলে, কফির কথা।’
কনিষ্ঠ সদস্য আবার লাফিয়ে ওঠে। দৌড় দেয় ক্যানটিনের দিকে। একটু পর ফিরে এসে বসতে বসতে বলে, ‘ভাই, বলে আসছি কফির কথা। সঙ্গে কেকও দিতে বলছি। শুধু কফি খাইলে খারাপ দেখায় না? ক তে কেক, ক তে কফি।’
‘বাহ্, ভালো। এবার বলো, কী ভাবলা।’
‘আমি এখনো কিছু পাই নাই। পেয়ে যাব। অন্যরা কী কী যেন ভাবছে।’
সম্পাদক তখন অন্যদের দিকে তাকান পর্যায়ক্রমে। টি-ব্যাগ যেমন লিকার ছড়ায় চারপাশ থেকে, ঠিক সেভাবে চারপাশ থেকে ভেসে আসতে থাকে নানা রকম মন্তব্য—
‘আমি? আমি তো মাত্র আসলাম। অ্যাই, তুই না কী যেন বলছিলি?’
‘আরে, ওইটা আমার আইডিয়া না। (পাশের জনকে দেখিয়ে) ওর আইডিয়া।’
‘আমি তো (পাশের জনকে দেখিয়ে) ওর আইডিয়ার কথা বললাম।’
‘ভাই, আমি একটা আইডিয়া ভাবছিলাম, কিন্তু ওইটা তো আমার শর্ট ফিল্মের আইডিয়া।’
এভাবে স্পেনের মতো একজন আরেকজনের কাছে পাস দেবে। একপর্যায়ে সম্পাদক গর্জে উঠবেন রাগী রেফারির মতো, ‘মানে কী? তোমরা রস+আলোর কোনো আইডিয়া ভাবো নাই?’ ঠিক এই সময় ট্রে-ভর্তি কফির মগ আর কেক নিয়ে ঢুকবেন মামুন ভাই। সম্পাদককে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে খাবারের ওপর।
কফি খেতে খেতে রস+আলো ছাড়া আর সব বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে। তারপর হুট করে দেখা যাবে ৬টা বেজে গেছে। কিন্তু এখনো কোনো আইডিয়াই বের হয়নি। সম্পাদক তখন ঝাড়ি দেবেন, ‘এরপর আমাদের ৫০০তম সংখ্যা। এটা নিয়ে আইডিয়া দাও।’
‘এটা কোনো ব্যাপারই না ভাই। স্ব স্ব ক্ষেত্রে আলোচিত ৫ জন “শ”-এর ছবি থাকবে, ওপরে হেডিং পাঁচ শ। যেমন জর্জ বার্নাড শ-এর ছবি।’
‘আর চার শ কে কে?’
‘তা তো জানি না। আমি এই একটা “শ”কেই চিনি। আরেকজন “শ” অবশ্য আছে। শ করিম মজুমদার।’
‘উনি কে?’
‘আমাদের শারীরিক শিক্ষার টিচার। ভাই, এক কাজ করেন। বার্নার্ড শ-এর ছবিই ৫টা দিয়ে দেন। শেয়ালের কুমিরের বাচ্চা সাতবার দেখানোর মতো।’
এ সময় ‘মিটিং কি শেষ?’ বলে মিটিংরুমে প্রবেশ করবে সর্বশেষ এক সদস্য (যার বাসা অফিসের সবচেয়ে কাছে)। তাকে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে সবাই। আবেগে সে মোবাইল ফোন বের করে বলবে, ‘ভাই, আসেন একটা সেলফি তুলি।’ সবাই সেলফি তুলবে। তখন তার মনে হবে, ‘হায় হায়, খাওয়াও শেষ? চলেন ভাই, নিচে গিয়ে চা খেয়ে আসি।’
‘হ্যাঁ, চলেন চলেন। অনেকক্ষণ খোলা আকাশ দেখি না।’
সম্পাদক হতাশ, ‘কিন্তু ৫০০ নিয়ে তো কিছু রেডি হইল না।’
‘হয়ে যাবে, পুরো জিনিসটা আমরা মাথায় নিয়ে নিয়েছি। এবার এত লেখা দেব, আপনার মেইল হ্যাং হয়ে যাবে।’
নিচে কয়েক দফা চা খেয়ে যে যার বাসায় চলে যায়। শুক্রবার সকালে সবার লেখা দেওয়ার কথা। সম্পাদক অফিসে এসে দেখেন, মেইলে দুয়েকটা স্প্যাম ছাড়া কিছু নাই। রেগেমেগে গ্রুপে পোস্ট দেন তিনি, ‘কী ব্যাপার? লেখা কই?’ সবাই সিন করে সেই পোস্ট, কিন্তু কেউ রিপ্লাই দেয় না। অনেকক্ষণ পর কিছু রিপ্লাই আসে—
‘ভাই, আমার জ্বর।’
‘লেখা হইছে, কিন্তু নেট নাই বলে পাঠাতে পারছি না।’
‘হার্ডডিস্ক ক্র্যাশ করসে।’
‘সকালে উঠে দেখি আমার সব চুল পড়ে যাচ্ছে, মনটা খারাপ। আমি নেক্সট সংখ্যা থেকে লেখা দেব। প্রমিজ।’
সম্পাদকের মাথায় হাত। কয়েকজনকে তিনি ফোন করলেন, ফোন বন্ধ। শেষে ভাবলেন, কী আর করা, নিজেই লিখে ফেলবেন। তখন টুংটাং বেজে উঠল তাঁর ফোন। একে একে মেসেজ, ‘ভাই, লেখা মেইল করছি। দেইখেন।’
তারপর সে লেখাগুলো সম্পাদনা করে পাঠানো হয় কার্টুনিস্টদের কাছে। তাঁরা এঁকে পাঠানোর পর গ্রাফিকস রুম হয়ে প্রেসে যায় রস+আলো। তারপর তো বুঝতেই পারছেন। দিনের পর দিন এভাবেই বের হচ্ছে রস+আলো। সম্পাদকের কালো চুল চিন্তায় সাদা হয়ে যাচ্ছে, চা-কফি খাওয়া হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। রস+আলোকে ছাড়িয়ে ফান করছে দেশের পাঠ্যবই, সরকার, রাজনীতিবিদ।
তবে রস+আলোর সদস্যরা প্রতি বুধবার ঠিকই মিটিং করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও করে যাবে। আপনার যদি মনে হয় জ্যাম ঠেলে মিটিং করার মতো অফুরন্ত সময় আছে, তাহলে চলে আসুন। সম্পাদকের মাথায় আরও কিছু কালো চুল অবশিষ্ট আছে, আপনারা এলে দ্রুতই সেগুলো রং ফিরে পাবে।