বছর তিন আগের কথা। আর সব দিনের মতো সকাল সাতটায় টেলিভিশনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের খবর শুরু হয়েছে কেবল। শিরোনামে সংবাদ পাঠক জানিয়ে দিলেন, ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে আত্মহত্যা করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার আরও এক জনপ্রিয় কে-পপ (কোরিয়ান পপ) গায়িকা। তিনি সাইবার বুলিংয়ের শিকার।
কে-পপের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। তারকা শিল্পীর এই আত্মহত্যার খবরে দেখলাম মূলধারার জাঁদরেল সব গণমাধ্যম সয়লাব। অভিযোগের তির গায়িকার সাবেক প্রেমিকের দিকে। অন্তরঙ্গ ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ক্যারিয়ার ধসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলেন তিনি। একটা সিসিটিভি ফুটেজও পায় পুলিশ, যেখানে তাঁকে হাঁটু গেড়ে সাবেক প্রেমিককে অনুনয়-বিনয় করতে দেখা যাচ্ছে।
সিউল থেকে ঢাকার দূরত্ব ৩ হাজার ৭৮৩ কিলোমিটার। কিন্তু একই ধাঁচের হয়রানির ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটছে। তারকারা তো বটেই, সাধারণ নারী-শিশুরাও এই দুনিয়ায় বিপন্ন। এই তো গত জুলাইয়ে হয়রানির শিকার হয়ে বাসাবোয় নিজেদের বাসায় আত্মহত্যা করল ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী। এ দেশেও তারকারা, যাঁদের বড় অংশ নারী, ব্যক্তিগত ভিডিও ফাঁসের ঘটনায় নাকাল হচ্ছেন। কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছেন।
তবে পুরুষেরাও যে এসব ঘটনার শিকার হচ্ছেন না, তা নয়।
কাগজে-কলমে ভার্চ্যুয়াল জগতে নানাবিধ হয়রানির নাম সাইবার বুলিং।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) সাইবার বুলিংয়ের একটা সংজ্ঞা দিয়েছে। তারা বলছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে উত্ত্যক্ত করাকে বলে সাইবার বুলিং। আর এই উত্ত্যক্ত করার কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, খুদে বার্তা, গেমিং প্ল্যাটফর্ম বা মুঠোফোন। উত্ত্যক্তকারীরা সাধারণত কোনো এক ব্যক্তিকে নিশানা করে ভয় দেখায়, রাগায় বা লজ্জা দেয়। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যাচার করা অথবা বিব্রতকর ছবি পাঠানো, ভিডিও পোস্ট করা; আঘাত পেতে পারে জেনেও কাউকে আক্রমণাত্মক কথা বলা বা ছবি দেওয়া, কারও পক্ষ হয়ে কাউকে বাজে কথা লিখে পাঠানো, অথবা ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে আজেবাজে আধেয় পাঠানো সাইবার বুলিংয়ের আওতার মধ্যে পড়ে।
পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সহকারী কমিশনার ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ বলছিলেন, সাইবার বুলিংয়ের পরিসর বেশ বড়। অন্তরঙ্গ ছবি ছড়িয়ে হয়রানি করা বা যৌন হয়রানি তো আছেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন আরও নানা অনুষঙ্গ।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছিলেন, একসময় স্রেফ মজা করার জন্য বানানো মিম দিয়েও এখন হয়রানি করা হচ্ছে। শুধু মানুষ নয়, বড় বড় প্রতিষ্ঠানও হতে পারে সাইবার হয়রানির শিকার। মোটরসাইকেলের একটি খ্যাতনামা ব্র্যান্ডের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে মামলা করেছে। ব্র্যান্ড প্রমোশনে একসময় যাদের তারা কাজে লাগাত, তারাই চুক্তি শেষে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নামে নোংরা কথা ছড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠান অল্প দামে মোটরসাইকেল বিক্রি না করায় ক্ষোভ থেকে তারা এই কাজ করে বলে অভিযোগ।
তবে এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীরাই সাইবার বুলিংয়ের প্রধান শিকার।
রাজধানীর একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। একাধিকবার সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন তিনি। ওই নারী বলেন, প্রথম বর্ষে পড়ার সময় মেসেঞ্জারের ইনবক্স খুলে একবার প্রচণ্ড ধাক্কা খান তিনি। গোপনাঙ্গের ছবি পাঠিয়েছেন এক ব্যক্তি।
কার কাছে গেলে প্রতিকার পাবেন, বুঝে উঠতে পারেননি ওই নারী। নিজেকেই তাই সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে গুটিয়ে নেন তিনি। নিষ্ক্রিয় (ডি-অ্যাকটিভেট) করে দেন ফেসবুক আইডি, পাল্টে ফেলেন ফোনের সিম।
একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন আরও অন্তত তিন নারী। গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের এক ছাত্র ও তাঁর দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে ইনবক্সে আপত্তিকর ছবি পাঠানো ও সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সে সময় জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় বা এড়িয়ে চলায় এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। কখনো কখনো ভুয়া আইডি থেকেও আসছে এমন ছবি।
ঢাকার ভাসানটেক থানায় ১৫ মার্চ মামলা করেছেন এক নারী। তাঁর মেয়ে অনলাইনে খাবার অর্ডার করার বেশ কিছুক্ষণ পর ডেলিভারিম্যান রোকন মিয়া জানান, রাস্তায় যানজট। তিনি খাবার পৌঁছাতে পারবেন না। শুনে খানিকটা রাগ করেছিলেন তাঁর মেয়ে। ওই দিন সন্ধ্যা থেকেই মেয়ের নম্বরে উটকো লোকজনের ফোন আসতে থাকে। অশ্রাব্য ভাষায় তাঁরা মেয়েটিকে নানা কিছু বলেন, অন্যায় প্রস্তাব দেন। কিছুদিন বাদে বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে। ভুক্তভোগী পরিবারটি জানতে পারে, ‘আলোর পথে’ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে প্রচার করা হয়েছে, তাঁর মেয়ের জন্য পাত্র দরকার।
তদন্তে নেমে পুলিশ দেখতে পায়, রোকন মিয়া ও তাঁর সঙ্গীসাথিদের একটি দল রয়েছে। তারা নারীদের ছবি তোলে এবং নোংরা আলাপ করে।
স্রেফ মজা করার জন্য ‘ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও জেলাভিত্তিক পেজ চালু আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চলতিপথে পছন্দ হয়েছে, এমন কারও ছবি দিয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন এই গ্রুপের লোকজন। এর মাধ্যমেও অনেকে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন।
কোনো একজন নারীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানির ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি দলবদ্ধভাবে হয়রানির ঘটনাও আছে। গত শনিবারের কথাই ধরুন। এআইইউবি ইন্টার কলেজ উইমেনস ক্রিকেট টুর্নামেন্টের একটি ভিডিও ক্লিপ সেদিন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। বোলার বল করেছেন, উইকেটে লেগেও বেল পড়েনি। তা নিয়ে নারীদের লক্ষ্য করে তির্যক মন্তব্যে কমেন্ট বক্স উপচে পড়তে দেখা গেছে।
জোটবদ্ধ হয়ে নারী তারকাদের অশ্লীল ভাষায় আক্রমণের নজির আছে ভূরি ভূরি। জনপ্রিয় অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার। একটি অনুষ্ঠানে তিনি সম্প্রতি তাঁর ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বিবরণ দেন। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া ওই অনুষ্ঠানের লিংকের নিচে সব মন্তব্যই ছিল আপত্তিকর ও তির্যক।
২০২০ সালের নভেম্বরে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন যাত্রা শুরু করে। প্রথম বছরে এই ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ১৭ হাজার ২৮০ জন নারী। তাঁদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার।
গত বছর ঢাকায় ৯০০-এর বেশি ঘটনা নিয়ে কাজ করেছে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। তাদের হিসাবে, সাইবার বুলিংয়ে নারী ও পুরুষের অনুপাত সমান। তবে ‘সেক্সটরশন’-এর (অন্তরঙ্গ ছবি/ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া) ক্ষেত্রে নারীরা ভুগছেন বেশি।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, টাকা না দিলে অন্তরঙ্গ ছবি/ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় পুরুষ ভুক্তভোগীর সংখ্যা ছিল ২৩, অন্যদিকে নারীর সংখ্যা ছিল চার গুণের বেশি, সংখ্যায় ১০০। ভুয়া আইডি থেকে সাইবার বুলিংয়ের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪৯, নারীর সংখ্যা ছিল ১০০।
তবে আইডি হ্যাকের শিকার হয়েছেন বেশিসংখ্যক পুরুষ, মোবাইল ব্যাংকিংয়েও পুরুষই বেশি ঠকেছেন।
বলিউড তারকা ক্যাটরিনা কাইফ সম্প্রতি বিয়ে করেছেন। বিয়েতে উপহার দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন তাঁর সাবেক প্রেমিকেরা। এ নিয়ে ফেসবুকে অনেক নারীকেই মন্তব্য করতে দেখা যায়। একজন লিখেছেন, এ দেশে আজকাল সাবেক প্রেমিকেরা বিয়ে না হলে একটা ভিডিও ক্লিপ ছেড়ে দেন, উপহার বলতে এ-ই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান সাইবার বুলিং রোধে পরিবারের ভূমিকাকে বড় করে দেখছেন। তিনি বলেন, প্রথমত ছেলেমেয়েদের সেক্স এডুকেশন (যৌন বিষয়ে শিক্ষা) প্রয়োজন। এতে তারা বিপরীত জেন্ডারের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করতে শিখবে। দ্বিতীয়ত, ছবি বা ভিডিও আদান-প্রদানে নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখা জরুরি। কতটুকু বিনিময় করা যাবে, সে সম্পর্কেও সন্তানদের ধারণা দেওয়ার দায়িত্ব বাবা-মায়ের।