
সুচিত্রা সেন। নামটিতেই যে অনিন্দ্যসুন্দর অবয়ব ভেসে ওঠে, তাঁর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে রূপকথার সেই ঘুমন্ত রাজকন্যাকে। কোনো এক পরির জাদুতেই হয়তো সাধারণ স্কুলশিক্ষক থেকে সুচিত্রা জয় করে নিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের মন। চুম্বক-আকর্ষণ বোধ হয় একেই বলে। অভিনয়, ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্যের এমন মিশেল পর্দায় হয়তো কখনো আর দেখা যাবে না। ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে রুপালি পর্দা তো বটেই তিনি ছিলেন একরকম লোকচক্ষুর অন্তরালে, অথচ এখনো তাঁর সৌন্দর্যে মুগ্ধ প্রতিটি বাঙালিহূদয়। স্নিগ্ধতা আর দৃঢ়তা—দুইয়ের মিশেলেই তাঁর সৌন্দর্য। গতানুগতিক কোমল নিবেদিতপ্রাণ নারী যেন তিনি নন। বরং তাঁর রূপের ছটায় প্রকাশ পায় একধরনের আত্ম-অহংকার, প্রখর ব্যক্তিত্ব এবং স্বাভিমান। সেই সময়ে সুচিত্র সেনের স্টাইল ছিল আধুনিক, আবার এই সময়ের অনেক তরুণীর কাছেও সুচিত্রা সেনের আবেদন কম নয়। তাঁর হাসির কথাই বলি।
বাঙালি কবিরা একেই বোধ হয় বলেন ভুবনমোহিনী হাসি। অগ্নিপরীক্ষা ছবিতে এ হাসি দেখেই মুগ্ধ হয়েছেন নায়ক। শুধু কি তাই, যতবার পর্দায় তাঁর হাসিমুখ ভেসে উঠেছে, তরুণ বাঙালি-দর্শকের হূৎকম্প কি থেমে যায়নি একটুক্ষণের জন্য! এ ছবিতে বেণি করে ফিতায় জড়ানো খোঁপার সাজ আর রং মেলানো ছাপা শাড়ি-ব্লাউজের স্টাইলও দারুণ পছন্দ করেছেন তাঁরা। ছোট্ট দুলের সঙ্গে বড় লকেটযুক্ত গলার চেন পরার স্টাইলও বোধ হয় তাঁকে দিয়েই শুরু হয়েছিল। সুচিত্রার চিবুকের তিল, সুবিন্যস্ত দাঁত, টিকালো নাকের থেকেও দর্শক ভালোবেসেছিলেন তাঁর বাঙ্ময় চোখ আর সেই চোখের ভাষা। পরিচালক সুকুমার রায় একবার তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ওর চোখ দুটি বড় সুন্দর আর এক্সপ্রেসিভ, চাহনিতে স্বচ্ছ গভীরতা, মিষ্টি হাসিতে সারা মুখখানা যেন উচ্ছলতায় ভরে যায়। একনজরেই পছন্দ হয়ে যাওয়ার মতো।’ আমার কাছে মনে হয়, একেবারেই সঠিক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
সাগরিকা ছবির কথা কার না মনে আছে! পঞ্চাশের দশকের এক ধনাঢ্য তরুণী। প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী এবং ফ্যাশনেবল। ঝোলানো দুল, কপালের টিপ আর জর্জেট শাড়িতে তাঁকে মনে হয়েছিল স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা; কিংবা সপ্তপদী ছবিতে মোটরসাইকেলে গাওয়া ‘এই পথ যদি না শেষ হয়...’ গানে তাঁর উড়তে থাকা ছোট চুল, বড় সানগ্লাস আর স্কার্ফ জন্ম দিয়েছিল নতুন ট্রেন্ডের। সেই ছবির অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রিনা ব্রাউন হয়ে উঠেছিলেন তখনকার ফ্যাশনের প্রতিমূর্তি। হারানো সুর চলচ্চিত্রের ড. রমাও কোনো দিক থেকে একঘেয়ে নন, বরং তাঁর একরঙা শাড়ি, হালকা মেকআপ আর টাইট করে বাঁধা চুল যেন কী এক রহস্যের ইঙ্গিত দেয়।
ভালোবাসতেন তিনি মুক্তার গয়না। তাঁর অনেক চলচ্চিত্র যেমন রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, পথে হল দেরী, হারানো সুর—এ তাঁকে পরতে দেখা গেছে নানা ধরনের মুক্তার গয়না। কানে সোনার বড় রিং, হাতে চিকন সোনার চুড়ি আর গলার চেনও বাঙালি নারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তাঁর কল্যাণে।
বেশির ভাগ ছবিতে সুচিত্রার সাজগোজ চিরায়ত বাঙালি নারীর মতো হলেও আমার কাছে মনে হয়, কোথায় যেন একটু পশ্চিমা টানও রয়েছে। নারী, কিন্তু মোটেই অবলা নয়। হাতে আঁকা ভ্রু আর ঘন করে দেওয়া কাজলেও যেন মায়াময়তার থেকে রহস্যময়তাই বেশি নজরে আসে। সাদাকালো ছবি বলে আইশ্যাডোর বৈচিত্র্য হয়তো সেভাবে লক্ষ করা যায়নি, কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, সেখানেও রয়েছে ভিন্নতা। কোথাও তার রং হালকা, কোথাও গাঢ়। ছোট করে টিপ পরতেন। শিল্পী ছবিতে তাঁর কপালে দু-একবার ছাড়া টিপ ছিল না, কিন্তু সাজে যে লাস্যময়তা ছিল, তা এককথায় চমৎকার।
থ্রি-কোয়ার্টার হাতার কাজ করা ব্লাউজ, শাড়িতে লেস এমনকি শুধু পনিটেইল করে চুলকে সামনে নিয়ে আসার স্টাইলে পঞ্চাশের দশকেও সুচিত্রা পুরো আধুনিক। টেনে খোঁপা করে কপালের ওপর কয়েক গাছি চুল ফেলে রাখার ফ্যাশনও কি তাঁর হাত দিয়েই শুরু হয়নি! যদিও চুল নিয়ে খুব বেশি নিরীক্ষা করেননি তিনি। দু-একটি ছবি, বিশেষ করে সপ্তপদী ছাড়া মাথায় বয়কাট চুল বা ফ্রিঞ্জ নয়, বাঙালি সাধারণ নারীর মতো চুল টেনে বেণি করা, মাঝে সিঁথি, খোঁপা কি এলোচুলেই অধিকাংশ সময় ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন। তাতেও সুচিত্রাকে ফ্যাশন-সচেতন মনে হয়েছে। শাড়ি পরার স্টাইলেও ছিল ভিন্নতা। একটু একপেশে কুঁচি এবং আঁচলটাকে টেনে সামনে নিয়ে এসে কোমরে গুঁজে দিতেন।
আঁধি ছবিতে একবার তরুণী, একবার প্রৌঢ় রাজনীতিবিদের ভূমিকায় অভিনয়ের চেয়ে অনবদ্য মনে হয়েছে তাঁর সৌন্দর্য। সেই ন্যুড লিপ, মোটা করে দেওয়া আইলাইনার, কালো টিপ আর সঙ্গে সিল্ক শাড়ি। সামনে কিছুটা সাদা চুল। এক কথায় অ-সা-ধা-র-ণ।
শাপমোচন, চন্দ্রনাথ, ত্রিযামা, ইন্দ্রানী, পথের দাবী—যে চলচ্চিত্রের কথাই বলা হোক না কেন, তাঁর স্টাইল, ফ্যাশন, সৌন্দর্য এককথায় আইকনিক। আটপৌরে বাঙালি নারীও যে কতটা আবেদনময় আর অনন্য হয়ে উঠতে পারে, সুচিত্রা যেন তাঁর প্রকৃত উদাহরণ।