
বয়স প্রায় ৯০ ছুঁই ছুঁই। ঈদকে তিনি দেখেছেন নানা রঙে, নানাভাবে। সেই সব বর্ণিল ঈদের স্মৃতিচারণা করেছেন বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম
ঈদের কথা বললেই ফিরে যাই আমাদের কলকাতার বাড়িতে। তখন আমি বেশ ছোট। কলকাতায় আসার আগে গ্রামে থাকতাম আমরা। আমার বাবা মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন তখন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক। গ্রাম থেকে আমি আর মা বাবার কাছে এলাম কলকাতায়। এই শহরের সবকিছু আমার ভালো লাগত। ঈদে খুব আনন্দ হতো। বাবা আমাকে নতুন পোশাক কিনে দিতেন। তবে এখনকার মতো মেয়েদের নিজে গিয়ে পোশাক কেনার সুযোগ ছিল না। বাবা-ভাই-স্বামীরা পছন্দ করে যা কিনে এনে দিতেন, তাই পরতে হতো। এখন তো মেয়েরা শহরের দোকান ঘুরে পোশাক জুতা ব্যাগ কেনেন। এত স্বাধীনতা সে সময় ছিল না। এ সময়ের মেয়েরা যে নিজের মতামতের প্রকাশ ঘটাতে পারছেন এটি খুব ভালো লাগে। তখন এসব ভাবাই যেত না। আমি মাকেও দেখেছি, হয়তো বলেছেন কোন রঙের শাড়ি আনতে হবে। বাবা তাই আনতেন। মা অবশ্য ঈদে লাল পাড়ের সাদা সুতির শাড়ি পরতেন। মা সব সময় বলতেন, আমি গ্রামের মেয়ে। এটিই আমার বেশি ভালো লাগে।
আমি বড় হওয়ার পর বাবা ঈদে সিল্ক শাড়ি কিনে দিতেন। বলে দিতাম, কোন ধরনের রং ও নকশা কিনে আনবেন। বিয়ের পর অবশ্য আমার স্বামী কিনে এনে দিতেন। কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার পর স্বামীর সঙ্গে গিয়ে শাড়ি কিনেছি। এখনকার মতো তখন ফ্যাশন ম্যাগাজিন ছিল না। তবে বাড়িতে বসেও নিত্যনতুন ফ্যাশন সম্পর্কে জানতে পারতাম। সেটিও একধরনের মজা ছিল। যেমন: বিভিন্ন বাড়ির মেয়েরা যখন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি বেড়াতে যেতেন। তাঁদের পোশাকগুলো খেয়াল করা হতো। দেখা যেত যে নকশা ও কাটের পোশাক বেশি পরছে মেয়েরা, ধরেই নেওয়া হতো সেটি এবারের ট্রেন্ড। এখন তো সবাই দরজির দোকানে গিয়ে ভিড় করেন। তখন বাড়ির মেয়েরা নিজের পোশাক নিজেই সেলাই করতেন। ঘরে ঘরে সেলাই মেশিন ছিল। আমার মাও ছোটবেলায় নকশা করা জামা সেলাই করে দিতেন।
আমি অবশ্য দুই দেশের দুই ধরনের ঈদের আবহ দেখেছি। কলকাতার মানুষেরা অনেক আধুনিক ছিলেন। কলকাতায় ঈদের যে আমেজ ছিল, শুরুতে ঢাকায় সেই আমেজ দেখতে পাইনি। আমি বাবার সঙ্গে গাড়ি করে একটু বের হতাম। আবার বাবার সঙ্গেই ফিরতাম। ঈদের আগে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে যা একটু ভিড় হতো। বাড়ির সবার জন্য পোশাক এখান থেকেই কেনা হতো। তখন তো এখনকার মতো এত শপিংমল, ফ্যাশন হাউস বা বুটিক হাউস ছিল না।
ঈদের রান্নার ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। আজকাল বাজারে নানা ধরনের গুঁড়া মসলা ও দেশ-বিদেশের হরেক রকমের উপকরণ পাওয়া যায়। রান্না নিয়ে নিরীক্ষা করেন মেয়েরা। দেশি পদ ছাড়াও ভিনদেশের নান পদ তৈরি করেন তাঁরা। আর আগেকার ঈদে ঐতিহ্যবাহী খাবারই রান্না হতো। ঈদের আগের দিন থেকে বাড়ির মেয়ে-বউয়েরা মসলা বাটতেন। রাতভর ঘরদোর গোছাতেন। সকাল থেকে আবার রান্না শুরু হতো। এখন তো ফ্রিজ আছে। আগে রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিতেন মেয়েরা। এতে সময়ও বাঁচে, নিজেরও বিশ্রাম হয়। সবার সঙ্গে আনন্দে যোগ দিতে পারেন।
আমার মা একধরনের হাত সেমাই তৈরি করতেন। অন্যান্য বাড়িতেও এ সেমাই পায়েস খাওয়া হতো বেশি। আমি মায়ের হাতের সেমাই খুব পছন্দ করতাম। বড় হয়ে নিজেও রান্না করেছি। আমার হাতের মোরগ পোলাও সবাই খুব পছন্দ করে। আমার কাছে ছোটবেলা ও বড়বেলার ঈদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে হাতে মেহেদি দেওয়া। কেউ কেউ এখন অবশ্য রূপচর্চাকেন্দ্রে গিয়ে মেহেদি দিয়ে নেন। কিন্তু আমাদের সময় বাড়িতে মেহেদির পাতা বেটে চাঁদরাতে মেহেদি দিত সব বয়সের মেয়েরা।
আরেকটি বিষয়ের কথা না বললেই নয়। ঈদের আগে এখন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনগুলোতে নানা রকমের রেসিপি প্রকাশিত হয়। বিশেষ ঈদসংখ্যা বের করা হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালে বেগম-এর প্রথম ঈদসংখ্যা প্রকাশ করি, যেখানে মেয়েদের ছবিসহ রেসিপি ছাপা হয়েছিল।
আসলে ঈদের আনন্দ হয়তো আগের মতোই আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে। আর আমার মনে হয় এই পরিবর্তন ইতিবাচক।
অনুলিখন: তৌহিদা শিরোপা