১০ বছরে ৮৫ জনের প্রাণহানি

সৈকতে গুপ্তখাল: পর্যটকের মৃত্যুফাঁদ

বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতটি এখন পর্যটকদের মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। সৈকতসংলগ্ন সমুদ্রে সৃষ্ট গুপ্তখালে আটকা পড়ে পর্যটকেরা হারিয়ে যাচ্ছেন প্রায় সময়। পুলিশ ও লাইফ গার্ড স্টেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিনসহ সৈকতের বিভিন্ন স্থানে গোসল করতে নেমে ৮৫ জন পর্যটকের প্রাণহানি হয়েছে। মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয় অন্তত এক হাজার ২০০ জনকে। এর মধ্যে কলাতলী থেকে ডায়াবেটিকস হাসপাতাল পয়েন্ট পর্যন্ত এলাকায় সৈকতে গোসল করতে নেমে মারা যান ৬২ জন। উদ্ধার করা হয় আরও ৮৪৯ জনকে। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা দুই শতাধিক।সর্বশেষ ৩ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় সৈকতে গোসল করতে নেমে গুপ্তখালে পড়ে মারা যায় চট্টগ্রামের খুলশী এলাকার স্কুলছাত্র মো. সান। এর আগে গত ২৯ জুলাই সন্ধ্যায় কলাতলী পয়েন্টে গোসল করতে নেমে গুপ্তখালে আটকা পড়ে মারা যান ঢাকার ক্লোজআপ ওয়ান শিল্পী আবিদ শাহরিয়ারসহ বিজ্ঞাপনী সংস্থা মাত্রার কর্মকর্তা মোস্তাকিন মাহবুব ও কাজী আশিক মোস্তফা। ২২ জুলাই মারা যান ঢাকার কলেজছাত্র ইহাম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, ডুবুরিরা উদ্ধার না করলে প্রায় প্রতিদিন একাধিক পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটত। তাঁরা বলেন, পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার জন্য সৈকততীরে হাজার-কোটি টাকা বিনিয়োগ করে প্রভাবশালীরা আধুনিক মানের অনেক হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ তৈরি করেন। কিন্তু মাত্র কয়েক লাখ টাকা খরচ করে সৈকতের নির্দিষ্ট অংশে লোহার জাল বা নেট দিয়ে ঘিরে পর্যটকদের নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। অন্যদিকে, পর্যটকেরা এ ব্যাপারে প্রশাসনকেই বেশি দায়ী করে বলেন, সৈকতকে ব্যবহার করে কোটি টাকা আয় হলেও এর একাংশও পর্যটকদের নিরাপদ গোসল নিশ্চিত করার কাজে ব্যয় করা হচ্ছে না। এমনকি সরকারিভাবে কোনো উদ্ধারকর্মী বা ডুবুরি নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ১০ বছরে ৮৫ পর্যটকের মৃত্যু: ইয়াছির লাইফ গার্ড স্টেশনের পরিচালক ও নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ডুবুরি মোস্তফা কামাল গত ১০ বছরে সৈকতের বিভিন্ন স্থানে গোসল করতে নেমে ৮৫ জন পর্যটকের প্রাণহানি ও এক হাজার ২০০ জনকে উদ্ধারের কথা নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, কলাতলী থেকে ডায়াবেটিক হাসপাতাল পয়েন্ট পর্যন্ত এলাকায় নিহত ৬২ পর্যটকের মধ্যে ৫১ পর্যটকের লাশ তাঁরাই উদ্ধার করেন। প্রয়োজন সাবধানতা: ডুবুরি মোস্তফা কামাল জানান, কলাতলী থেকে ডায়াবেটিক হাসপাতাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সৈকতে বর্তমানে ছয়টি গুপ্তখাল সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে ওই এলাকায় গোসল করা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ডুবুরিরা জানান, প্রায় এক বছরের মধ্যে কলাতলী থেকে ডায়াবেটিক হাসপাতাল পয়েন্ট পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে আড়াআড়িভাবে কয়েক শ ফুট লম্বা ছয়টি গুপ্তখাল এবং ১০টির মতো পুকুর আকৃতির গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ভুলক্রমে কেউ পা পিছলে খাল বা গর্তে পড়ে গেলে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে।কক্সবাজার হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার জানান, কিছু প্রভাবশালী সৈকতের বিভিন্ন স্থান থেকে মেশিনের মাধ্যমে বালু তুলে হোটেলের সামনে প্রতিরক্ষা বাঁধ, হাঁটাচলার রাস্তা ও হোটেল নির্মাণের জায়গা ভরাট করছেন। এ কারণে বিভিন্ন স্থানে গুপ্তখালের সৃষ্টি হচ্ছে। কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা জানান, সমুদ্রের তলদেশ থেকে বালু তুলে জমি ভরাট ও রাস্তা তৈরির দায়ে সি-ক্রাউন, সি-ওয়েভ, ফকির গ্রুপসহ আটটি হোটেল মালিকের বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিল বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। কর্মকর্তারা সরেজমিন তদন্তে এসে এর সত্যতাও পান। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ঝুঁকি নিয়ে গোসল: রবি লাইফ গার্ড স্টেশনের পরিচালক সৈয়দ নুর বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রতিদিন শত শত পর্যটক উত্তাল সাগরে ঝাঁপ দিচ্ছেন জোয়ার-ভাটা উপেক্ষা করে। ফলে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন অনেকে। বেসরকারি ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান ‘বে অব বেঙ্গল ট্যুরিজমের’ পরিচালক তোফায়েল আহমদ জানান, প্রতিবছর কক্সবাজার ভ্রমণে আসেন অন্তত ১৫ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটক। এর মধ্যে বেশির ভাগ পর্যটক চান সৈকত দর্শন এবং সমুদ্রে নেমে গোসল করতে। কিন্তু এখানে নিরাপদ গোসলের জন্য প্রয়োজনীয় নেটিং সিস্টেম চালু করা সম্ভব হয়নি। নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা, ভ্রমণের সময় পুলিশি নিরাপত্তা, সৈকতে লাইটিংসহ ১৪ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে টুয়াক পাঁচ বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে। এর মধ্যে পুলিশি নিরাপত্তা জোরদার করা ছাড়া আর কোনো দাবি পূরণ হয়নি। সৈকত ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠিত বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. জয়নুল বারী বলেন, ‘সৈকতে পর্যটকের প্রাণহানির ঘটনায় আমরাও উদ্বিগ্ন। পর্যটকের নিরাপদ গোসল ও সেবার মান নিশ্চিত করতে উদ্ধারকর্মী নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’পুলিশ সুপার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানান, কক্সবাজার জেলা পুলিশ ভ্রমণে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরাপদ গোসল ও গুপ্তখাল সম্পর্কে পর্যটকদের সচেতন করতে প্রচারণা চালাচ্ছেন। ছয় দফা নির্দেশনা সংবলিত ৩০ হাজার প্রচারপত্র ইতিমধ্যে পর্যটকদের মাঝে বিলি করা হয়েছে।