
ছেলেটার নাম মাহমুদুল হক দিনার। আমার স্কুলজীবনের প্রথম বন্ধু। ক্লাসে ওয়ানে পরিচয়। দুজনের সে কী ভাব! একসঙ্গে বসতাম, দেখাদেখি করে অঙ্ক করতাম। দিনার কী গল্প করত খেয়াল নেই, তবে আমি টিনটিন পড়ে পাওয়া সব অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বেশ ঝেড়ে দিতাম! স্কুলের পুরোনো দালানের গলি-ঘুপচি, তালাবদ্ধ ঘরের কাচভাঙা জানালা আর উঁচু সিঁড়ি ডিঙিয়ে দুজন রহস্যের গন্ধ খুঁজতাম।
আমাদের স্কুলে একটা নিয়ম ছিল, ক্লাসের বাইরে, উঠানে বা বাথরুমে অপরিচিত কোনো বাচ্চাকে দেখলেই বড় ক্লাসের ছেলেরা জিজ্ঞাসা করত, ‘কোন ক্লাস?’ যদি জুনিয়র খুঁজে পাওয়া যায় তো গম্ভীর কণ্ঠে তাকে শোনানো হতো, ‘তোমার ব্রাদার, মুখে আঙুল।’ এই বাক্যের মর্মার্থ হলো, ‘আমি তোমার সিনিয়র ভাইয়া, এখন মুখে আঙুল দিয়ে সোজা কেটে পড়ো।’ ক্লাস ওয়ানে এই যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ। ক্লাস টু-তে উঠেই আমরা আমাদের চেয়ে পুঁচকেদের সঙ্গে এই খেলা শুরু করলাম।
হঠাৎ একদিন রং নম্বরে ডায়াল। আমি আর দিনার ক্লাস থ্রির একজনকে ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘কোন ক্লাস?’। বয়সে বড় কাউকে কোন ক্লাসে পড়ে জানতে চাওয়া মানে দুর্যোগ ডেকে আনা। আমি আমতা আমতা করে মাথাটাথা চুলকে সরি বলতে যাব, পাশ থেকে দিনার ‘ আমরা ক্লাস ফোর, তোমার ব্রাদার, মুখে আঙুল’ বলে হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমাকে নিয়ে এলাকা পার! ভাগ্যিস দিনার মাথা খাটিয়েছিল।
ক্লাস টু-তেই দিনার জানায়, তার বাবা বদলি হয়ে যাবে দিনাজপুর না রংপুর। ওকে স্কুল ছেড়ে দিতে হবে । ‘ট্রান্সফার’ শব্দটা জীবনে ওই প্রথম শুনলাম। বন্ধু কী বস্তু আর সেটা হুট করে আর থাকবে না জানলে কেমন লাগে, তাও বুঝেছিলাম। কিন্তু রাতের বেলা ঘুম থেকে জেগে কেন আমি হাউমাউ করে কান্নাকাটি করেছিলাম, বাসার কেউ তা বোঝেনি।
প্রথম কিছুদিন চিঠিতে যোগাযোগ হতো। তারপর হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ। বড় হয়ে অনেক খুঁজেছি আমার এই ছোটবেলার বন্ধুটাকে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে লিখি, ‘আমাদের সঙ্গে পড়ত মুখে আঙুল দেওয়া কোনো বাচ্চার সঙ্গে যদি কারও যোগাযোগ থাকে তো জানাবেন প্লিজ!’
আমার ছোট্টবেলার বন্ধু দিনার। দেখা হলে ওর সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হব! দুজন দুমগ কফি সামনে নিয়ে বসব। আর জানতে চাইব, ‘বন্ধু, কী খবর বল!’
শরীফ ওয়ালী
উত্তর চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ।