
কাজী নজরুল ইসলাম তরুণকে বলেছেন বীর হতে, ‘চির উন্নত শির’ হতে। তাই বলে শির নত করাটাও কি কখনো কখনো বীরের গুণ নয়? গুণীজনেরা বলেন, নিজের ভুলের জন্য ‘আমি দুঃখিত’ বলাটা কারও দুর্বলতা নয়। তবু ছোট্ট করে ‘স্যরি’ বলতে আমাদের কতই-না বেগ পোহাতে হয়! মুঠোফোনের খুদেবার্তা, ফেসবুকের মেসেজ যখন মনের ভাব প্রকাশকে সহজ থেকে সহজতর করে তুলছে, তখন তরুণেরা কীভাবে অন্যের কাছে ভুল স্বীকার করেন?
ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে নিয়ে অপরিচিত কারও পায়ে পা লেগে গেলে চট করে ‘স্যরি’ বলতে বাধে না। কিন্তু মাকে, বাবাকে, ভাইকে, বোনকে, বন্ধুকে ‘আমি দুঃখিত’ বলার আগে কত প্রস্তুতি নিতে হয়! এই বিষয়টি নিয়েই কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের লেখক কেলসি ফ্রিজেল। তিনি লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় যখন আমি আমার বোনের খেলনা কেড়ে নিতাম, ভাইয়ের সঙ্গে দুষ্টুমি করতাম, মা হাত ধরে বলতেন, “স্যরি বলো”। বলতাম। যতক্ষণ না আমার কণ্ঠস্বরে আমাকে যথেষ্ট অনুতপ্ত মনে হতো, বারবার স্যরি বলতাম। দুঃখিত হওয়াই তখন ভুল স্বীকারের প্রথম ধাপ ছিল। মানুষের চরিত্রের জটিলতা, অহমিকা ছোটবেলায় বুঝতাম না। এখন বুঝি। এখন পরিবারে সামান্য একটা ঝগড়া হলে একে অপরের সঙ্গে কথা বলি না দিনের পর দিন। কারণ, কেউই আগে মাথা নিচু করতে রাজি না। অথচ ক্ষমা চাওয়া যে দুর্বলতার লক্ষণ, সেটা কে ঠিক করে দিল!’
কেউ ঠিক করে দেয়নি। তবু ‘দুঃখিত’ বলার শক্তি ‘অর্জন’ করতে হয়। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন রেজাউল (ছদ্মনাম)। এক রাতে মায়ের সঙ্গে তুচ্ছ একটা কারণে ঝগড়া করেছিলেন, উঁচু গলায় কথা বলেছিলেন। পরদিন থেকে কেন যেন সহজ হতে পারছিলেন না। দুজন এক টেবিলে বসে নাশতা করেন, অফিস থেকে ফিরে রাতে একসঙ্গে খান, কিন্তু কথা হয় না। তারপর? রেজাউল বলেন, ‘একদিন সকালে বাসা থেকে বের হব। মা তখনো ঘুম থেকে ওঠেননি। একটা কাগজে লিখলাম “স্যরি”। লিখে মায়ের বিছানার পাশে রেখে এলাম। রাতে বাসায় ফিরে দেখি আবার সব স্বাভাবিক। উফ, মনে হলো বুক থেকে পাথর নেমে গেছে!’
হ্যাঁ, ভুল স্বীকার করতে মনের জোর লাগে। তার চেয়েও বেশি জোর লাগে ভুল শুধরে নিজেকে বদলাতে। তাই অন্যের কাছে দুঃখিত হওয়ার পাশাপাশি নিজের কাছে ‘দুঃখিত’ হওয়াটাও জরুরি। শুধু বলার জন্য বলা নয়, নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হোন। কীভাবে ‘স্যরি’ বলবেন, এ সম্পর্কে বেশ কিছু পরামর্শ আছে ইন্টারনেটে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুঃখ প্রকাশের প্রক্রিয়া নির্ভর করে যাঁর কাছে দুঃখ প্রকাশ করছেন তাঁর সঙ্গে আপনার সম্পর্কের ওপর। শুধু ভুল স্বীকার নয়, সঙ্গে এই ভুল আর করবেন না, মনে মনে এমন প্রতিজ্ঞাও করুন। দুঃখ প্রকাশের সময় ভুলের কারণ দাঁড় করাতে চেষ্টা করবেন না, কোনো অজুহাত দেবেন না। আপনি যে যথেষ্ট অনুতপ্ত, সেটাই বরং স্পষ্ট করে বলুন। এই মাথা নতই আপনাকে ‘উন্নত’ করবে।
কীভাবে ‘দুঃখিত’ বলব?
দ্য গার্ডিয়ান-এ লেখিকা লরেন কোক্রেন ‘সরি’ বলার কিছু উপায় বাতলে দিয়েছেন। তিনি বলছেন, কারও মন গলানোর একটা ভালো উপায় হচ্ছে জড়িয়ে ধরা। মানুষটি যদি আপনার বাবা-মা, বন্ধু কিংবা খুব কাছের কেউ হয়, কোনো কথা না বলে হঠাৎ শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন। তারপর দুঃখ প্রকাশ করুন।
সামনাসামনি না বলতে পারলে চিঠি লেখুন। কাগজে, কিংবা অনলাইনে।
হাতে বানানো কার্ড দিতে পারেন।
আপনার আঁকার হাত খুব ভালো না হলেও কার্ডে ছেলেমানুষি কোনো ছবি এঁকে দিতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, খাওয়ার সময় মানুষের মন ভালো থাকে। যার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে চান, সুযোগ পেলে তাঁকে কোনো ভালো রেস্তোরাঁয় খাওয়ান। অথবা তাঁর পছন্দের কোনো খাবার নিয়ে হাজির হোন, হতে পারে ‘আমি দুঃখিত’ লেখা কোনো কেক। খেতে খেতে দুঃখ প্রকাশ করুন।