বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা শেষে বিল দেওয়ার সময় আমরা প্রায়ই এক নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা করি। কে বিল দেবে, তা নিয়ে শুরু হয় তর্কবিতর্ক। একজন বলেন, ‘আমি দিচ্ছি।’, আরেকজন বলেন, ‘না না, আমি দেব।’ এই ‘তুই দে’-‘আমি দিচ্ছি’র খেলাটা যতক্ষণ চলে, ওয়েটার বা রেস্তোরাঁর লোকেরা দাঁড়িয়ে থাকেন দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে। এর মধ্যেই বন্ধুদের কেউ কেউ আবার বলে ওঠেন, ‘এই খাবারের দাম আমি দেব, ওইটা তুই দে।’ অর্থাৎ একেকজন কেবল নিজের খাবারের দাম আলাদা করতে চান। তখন পুরো ব্যাপারটাই হয়ে দাঁড়ায় হিসাবের খেলা। এর সমাধান কী?
ভাবুন, অফিস শেষে একটি অভিজাত রেস্তোরাঁয় বন্ধুরা বসেছেন খাবার নিয়ে। খাওয়াদাওয়া শেষ, এবার বিল আসতেই শুরু হলো গল্প। নাহিয়ান বলছেন, ‘আমি শর্মা খেয়েছি, তাই শর্মার দাম আমি দেব।’ সাব্বির বলছেন, ‘আমি শুধু সুশি খেয়েছি, সেটার দাম আমি দেব।’ সদ্য চাকরি পাওয়া তানহা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘গতবার বিল দিয়েছিলাম আমি, এবার দেবে ইশফাক।’ অথচ ইশফাক বলছেন, ‘আমার কার্ড বাসায় রেখে এসেছি।’
ওয়েটার তখন দাঁড়িয়ে ভাবছেন, কার থেকে টাকা নেবেন আর কোন কার্ডে বিল করবেন! পেশাগত নিয়মের কারণে মুখে হাসি ধরে রাখতে গিয়ে কিছু বলতেও পারছেন না। শাঁখের করাতের মতো অবস্থা—বিল তো নিতে হবে, আবার কারও মনোকষ্টের কারণও হওয়া চলবে না।
এমন পরিস্থিতি আদতে অযথাই তৈরি হয়। অনেকেই মনে করেন, খাওয়ার পর বিল ভাগ করা ন্যায্য ও ভদ্রতার পরিচয়। কিন্তু রেস্তোরাঁর কর্মীদের জন্য এটি বাড়তি ঝামেলা। চার-পাঁচটা ক্রেডিট কার্ড একসঙ্গে ধরিয়ে দিলে সমস্যা মিটে যায় না, বরং সময় নষ্ট হয়।
বিল সমান ভাগে ভাগ করলে তেমন অসুবিধা হয় না। কিন্তু ‘কে কী খেয়েছে’—এই হিসাব করতে গেলে বাধে গন্ডগোল। তখন বিল ভাগ করতে গিয়ে রেস্তোরাঁর কর্মী হিমশিম খান। একের বেশি কার্ডে ভাগ করলে কার কার্ড কোন বিলের জন্য, সেটাও মিশে যায়। ভিড়ভাট্টার মধ্যে এভাবে বিল নিতে গেলে পুরো প্রক্রিয়াই হয়ে যায় ধীর, ইন্টারনেট সমস্যা বা মেশিনের ত্রুটি হলে তো বোঝার উপর শাকের আঁটি।
অনেকেই বিলের হিসাব করাকে একধরনের গাণিতিক সমস্যা বানিয়ে ফেলেন। ফলাফল—ভুল হিসাব, অতিরিক্ত সময় নষ্ট, আর ওয়েটারের বিরক্তি। খাওয়াদাওয়ার আনন্দ শেষ হয়ে যায় সংখ্যার খেলায়।
সব পরিস্থিতিতে বিল সমানভাবে ভাগ করা যায় না। ছোট দলে (২-৪ জন) সমস্যা হয় না, কিন্তু দল বড় হলে (৫ জন বা বেশি) বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। অনেক সময় একসঙ্গে ছয়-সাতটি কার্ড দিয়ে বিল মেটানোর চেষ্টা হয়, যা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। এ জন্য পশ্চিমা দেশগুলোতে ‘পে অ্যাট দ্য টেবিল’ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। কিউআরকোড বা কার্ড রিডার দিয়ে সরাসরি টেবিলে পেমেন্ট করা যায়। খাবারের শুরুতেই যদি বলা হয়, কে কীভাবে বিল দেবেন, তাহলে শেষ মুহূর্তে কোনো গোলমাল হয় না।
একজন আগে পুরো বিল মিটিয়ে ফেলুন, অন্যরা পরে অ্যাপ বা নগদ টাকায় বিল মেটান। সুযোগ থাকলে প্রযুক্তি ব্যবহার করুন—কিউআর কোড, মোবাইল পেমেন্ট, কার্ড রিডার ইত্যাদি। খাবারের শুরুতেই ঠিক করে নিন, বিল ভাগ হবে নাকি একজন দেবেন। ভদ্রতা বজায় রাখুন, ‘এবার আমি দিলাম, পরেরবার তুমি দিয়ো’—এমন প্রস্তাব বরং তুলনামূলক ভালো। দাওয়াত দিলে বিল দেওয়া আপনার দায়িত্ব।
খাওয়ার টেবিলে বসা মানে শুধু খাওয়া নয়, বরং আড্ডা আর গল্পে সম্পর্ক ঝালাইয়ের সময়। সেখানে খাবারের বিলের মতো বিষয় নিয়ে বন্ধুত্বে ফাটল ধরানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিল নিয়ে ঝগড়া বা হিসাব-নিকাশের মধ্যে মূল আনন্দই নষ্ট হয়ে যায়। তাই সহজ পথ বেছে নিন, সময় বাঁচান, আর সম্পর্ক অটুট রাখুন।