ছোটদের মিষ্টি হাসি মন যেমন ভরায়, তেমনই তাদের হঠাৎ অদ্ভুত আবদারে বেশ অসহায়ও লাগে। ‘টডলার’ বয়স অর্থাৎ ১ থেকে ৩ বছর বয়সী অনেক শিশুই হঠাৎ করে জামাকাপড় নিয়ে সচেতন হয়ে পড়ে। নিজের পছন্দের পোশাক পরা, একই পোশাক দিনের পর দিন পরতে চাওয়ার মতো নানা বিপত্তি দেখা যায়। দুদিন আগেও যে শিশুকে যা দিয়েছি, সেটাই পরেছে; হঠাৎ এক সকালে সে আর নতুন পোশাক পরবে না। নানা অনুনয়-বিনয়, এমনকি ‘হুমকি’ দিয়েও তাকে নতুন কাপড় পরানো যাচ্ছে না। সন্তান বড় করা অনেক মা-বাবাকেই এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে মা-বাবারা চিন্তিত হয়ে পড়েন, কেউ কেউ সন্তানকে মেরেও বসেন।
অথচ এই নতুন কাপড় পরতে না চাওয়ার পেছনে থাকতে পারে অন্য কারণ। যার নাম সেন্সরি প্রসেসিং ডিজঅর্ডার (এসপিডি)। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এটি এমন এক স্নায়বিক অবস্থা, যেখানে শিশুর মস্তিষ্ক তার চারপাশের স্পর্শ, শব্দ, গন্ধের মতো অনুভূতিগুলো সঠিকভাবে প্রক্রিয়া করতে পারে না। ফলে অতি সামান্য বিষয়ও তাদের কাছে অসহ্য বা যন্ত্রণাদায়ক মনে হতে পারে। যেমন জামার ট্যাগ, কাপড়ের খসখসে ভাব অথবা গায়ের পোশাকটির হালকা চাপ শিশুর কাছে অসহ্য লাগতে পারে।
সাধারণত আড়াই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে এ ধরনের আচরণ বেশি দেখা যায়। তবে আশার কথা হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি সাময়িক। ধৈর্য ও ভালোবাসার মাধ্যমে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব।
এবার আসি রিশানের গল্পে। আমি রিশানের মা। আমার ছেলে রিশানের বয়স যখন আড়াই বছর, তখন থেকেই জামাকাপড় নিয়ে অদ্ভুত সব আপত্তি শুরু করল। বিশেষ কয়েকটা রং বা নকশা ছাড়া কিছুই পরতে চাইত না। ঢাকার আবহাওয়াও খুব একটা আরামদায়ক ছিল না, তাই ভাবলাম, গরমে হয়তো তার অস্বস্তি হচ্ছে। হয়তো কোনো দাওয়াতে যাব, সে রাতে ঘুমানোর পোশাকই পরে যাবে বলে বায়না ধরল। এরপর যখন তার তিন বছর বয়স, হঠাৎ করেই জামাকাপড় পরা একদম বন্ধ করে দিল।
তখন আমরা সবে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে এসেছি। তাপমাত্রা তখন মাইনাস চার ডিগ্রি সেলসিয়াস। রিশানের জন্য এখানকার ঠান্ডা আবহাওয়ার উপযোগী গরম কাপড় কিনে এনেছিলাম দেশ থেকে। ভেবেছিলাম, ঠান্ডার কারণে হয়তো রিশান সহজেই সেসব পরবে। কিন্তু না, রিশান শুধু ডায়াপার পরে থাকত। কিছুতেই তাকে কাপড় পরাতে পারছিলাম না।
আমরা অসহায়ভাবে দেখতাম, কনকনে ঠান্ডায় রিশান কাঁপছে অথচ জামা পরছে না। মা হিসেবে সেই অসহনীয় অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কয়েক সপ্তাহ যুদ্ধ করে হেরে গেলাম ছেলের কাছে। অবশেষে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ থেকে তার পুরোনো জামাগুলো আনিয়ে নিলাম, যেসব সে ঢাকার বাসায় পরত। সেখান থেকে রিশান দুটি পুরোনো নীল রঙের জামা আর একটা বেগুনি রঙের প্যান্ট পরা শুরু করল। এরপর টানা ৭৮ দিন সে কেবল ওই পোশাকগুলোই পরেছে। রাতে সে ঘুমিয়ে গেলে কাপড়গুলো ধুয়ে শুকিয়ে রাখতাম, যাতে পরদিনও সেসব পরতে পারে। জামার এই পুনরাবৃত্তিই আমাদের দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত হলো।
অমন পরিস্থিতিতে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, রিশানের মধ্যে এসপিডির লক্ষণ আছে কি না। ইন্টারনেটে অনেক প্রবন্ধ পড়েছি এ বিষয়ে। ইউটিউবে শিশুদের ব্রাশিং থেরাপির ভিডিও দেখেছি। বাংলাদেশে একজন শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও পরামর্শ করেছি। বুঝতে পারলাম, রিশানের মধ্যে কিছু লক্ষণ থাকলেও, পুরোপুরি এসপিডি বলা যায় না। মা হিসেবে তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, কোনো জোরজবরদস্তি নয়। কেবল কাউন্সেলিং করেই এ সমস্যার সমাধান করব।
প্রথমত, রিশানের জামাগুলো আমি ঘরের বিভিন্ন কোণে ছড়িয়ে রাখলাম। খাটের পাশে, খেলনার কাছাকাছি, যাতে জামাগুলো তার কাছে পরিচিত মনে হয়। প্রতিদিন সকালে তার সঙ্গে নতুন জামা পরার বিষয়ে গল্প করতাম। জামা তার হাত-পায়ে বুলিয়ে বলতাম, ‘দেখো তো, এটা কত নরম! একদম পরিষ্কার একটা জামা, কত রঙিন!’
এরপর প্রযুক্তির সাহায্য নিলাম। এআই ব্যবহার করে রিশানের মতো দেখতে একটি ছেলের ছবি তৈরি করলাম, যে নতুন জামা পরে। ছবিগুলো দেখিয়ে তাকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতাম, ‘নীল জামা আর বেগুনি পায়জামা ছাড়া কত সুন্দর সুন্দর রঙের পোশাক আছে, দেখো! এসব পরলে কত সুন্দর লাগে।’
এআই দিয়ে এরপর কিছু ভিডিও বানিয়ে ফেললাম। যেখানে কার্টুন চরিত্র রিশানকে বলছে, নতুন পোশাক পরলে তাকে কত সুন্দর লাগবে। এক মিনিটের বেশ কয়েকটি ভিডিও বানিয়ে সেসবই বারবার ওর সামনে ছেড়ে রাখলাম। আশ্চর্যজনকভাবে ৭৮ দিন পর আমার ছেলে নতুন জামা পরতে রাজি হলো!
এখনো মাঝেমধ্যে জেদ করে। কিন্তু প্রতিদিনই নতুন নতুন কৌশলে চেষ্টা করি। কোনো দিন আমরা রং দিয়ে খেলি, কোনো দিন ওর সঙ্গে বসে জামার ছবি আঁকি। আর এসবেই রিশানের পোশাকের প্রতি একধরনের আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে।
এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া মা-বাবাদের জন্য পরামর্শ আকারে আমার কিছু অভিজ্ঞতা জানাতে চাই।
১. ধৈর্য ধরুন। সময়টা পেরিয়ে যাবে, শুধু একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
২. আরামদায়ক পোশাক পরানোর চেষ্টা করুন। নরম, ট্যাগবিহীন ও পরিচিত কাপড়ের পোশাক কিনুন সন্তানের জন্য।
৩. সন্তানকে পোশাকের প্রতি আগ্রহী করতে তার সঙ্গে পোশাক নিয়ে খেলুন। নানা রকম পোশাকের ছবি আঁকুন, গল্প তৈরি করে শোনান।
৪. জামা পরলে শিশুর প্রশংসা করুন। তাকে ছোটখাটো পুরস্কার দিন।
৫. নিজেকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরুন। আপনি জামা পরলে সে দেখবে এবং উৎসাহিত হবে। ক্ষেত্রবিশেষে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে পোশাক পরাতে পারেন। এতেও কাজ হতে পারে।
৬. এআই বা ভিডিও ব্যবহার করুন। পোশাকের বিষয়ের গল্প ও মজার ছবি দিয়ে তাদের মন জয় করা যেতে পারে।
আমি রিশানকে প্রতিদিন বোঝার চেষ্টা করি, তাকে সময় দিই এবং কল্পনার জাদুকরী জগতে তার সঙ্গে প্রবেশ করার চেষ্টা করি। আপনার সন্তানের ক্ষেত্রেও হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। তবে আপনার ভালোবাসা আর ধৈর্যই পারে সব জয় করতে।