
নানা কারণে আমাদের ভেতরে উদ্বেগ জাগে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন বলছে, ভয়, আশঙ্কা ও অস্বস্তির অনুভূতিই উদ্বেগ। এর ফলে ঘাম, অস্থিরতা, দ্রুত হৃৎস্পন্দন দেখা দেয়। এর একটি সাধারণ রূপ হলো জনসমক্ষে কথা বলার ভয়—যেখানে হাত–পা কাঁপে, গলা কাঁপে, কথাই যেন আটকে যায়। এই স্নায়ুচাপ অনেক সময় আতঙ্কেও রূপ নেয়। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই, এর সমাধান আছে।
হয় কি, কথা বলতে বলতে আপনি খেই হারিয়ে ফেলছেন; বুঝতে পারছেন না, এরপর আপনি কী বলবেন। আবার শ্রোতাদের মধ্য থেকে কোনো প্রশ্ন এলে তার যথাযথ উত্তর আপনি দিতে পারেন না। এমন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হলে আগে জানতে হবে, আপনি কী বিষয়ে কথা বলতে চান।
আপনি বিষয়বস্তু সম্পর্কে যত ভালোভাবে বুঝবেন এবং বিষয়টি নিয়ে যত বেশি যত্নবান হবেন, তত আপনার ভুল করার আশঙ্কা কমবে। মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেললেও দ্রুত নিজের কথার প্রসঙ্গে ফিরে আসা সহজ হবে।
আপনি কী উপস্থাপন করবেন, আগে থেকেই তা ভালোভাবে পরিকল্পনা করুন। এর জন্য কোনো প্রপস বা অডিও–ভিজ্যুয়ালের সহায়তা প্রয়োজন হলে সেসবও অন্তর্ভুক্ত করুন। আপনি যত বেশি গোছানো থাকবেন, স্নায়ুচাপে তত কম ভুগবেন।
একটি ছোট কার্ডে বক্তৃতার আউটলাইন লিখে রাখুন। সম্ভব হলে আগে থেকেই জায়গাটি ঘুরে দেখুন, সরঞ্জামগুলো পরীক্ষা করুন এবং মূল প্রেজেন্টেশন বা উপস্থাপনার আগে একবার বক্তব্য অনুশীলন করে নিন।
কোনো কিছু উপস্থাপন করার আগে বারবার অনুশীলন করার কোনো বিকল্প নেই। তাই আপনিও আপনার উপস্থাপনাটি কয়েকবার অনুশীলন করুন। যাঁদের সঙ্গে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাঁদের সামনে অনুশীলন করুন এবং প্রতিক্রিয়া জানতে চান।
পাশাপাশি অচেনা কয়েকজনের সামনেও অনুশীলন করতে পারেন, এটা দারুণ কাজে দেবে। চাইলে নিজের উপস্থাপনা ভিডিও করে পরে দেখে উন্নতির জায়গাগুলো খুঁজে নিতে পারেন।
কোনো কিছু নিয়ে যখন আমাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা কাজ করে, তখন সেটা আসল পরিস্থিতির তুলনায় বড় মনে হয়। তাই কোন কোন বিষয়ে আপনার মধ্যে দুশ্চিন্তা কাজ করছে, সেসব খুঁজে বের করে লিখে ফেলুন।
তারপর বুঝতে চেষ্টা করুন আর কী কী হতে পারে এবং সেসব আদতেই ঘটবে, এমন কোনো প্রমাণ আছে কি না। যদি থাকে, তাহলে সেসবও লিখে ফেলুন। সেই সঙ্গে আগের উপস্থাপনাগুলো কেমন হয়েছিল, সেটিও ভাবুন।
আপনার উপস্থাপনাটি কেমন হবে, ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন কি না, এসব ভাবা বাদ দিন। ধরে নিন, আপনার উপস্থাপনা খুবই ভালো হবে।
মনে রাখবেন, ইতিবাচক চিন্তা সামাজিক পারফরম্যান্স নিয়ে দুশ্চিন্তা কমায় এবং উদ্বেগ হ্রাস করে।
খুবই প্রশান্তিদায়ক একটি কাজ হচ্ছে গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া। মঞ্চে ওঠার আগে এবং উপস্থাপনার সময় কয়েকবার ধীর ও গভীর শ্বাস নিন।
সাধারণত উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি হয় উপস্থাপনার শুরুতেই, কয়েক মিনিট পর তা কমে যায়।
কোনো বিষয় কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তার চেয়ে মানুষ আদতে নতুন তথ্যের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। তাই শ্রোতার দিকে মনোযোগ না দিয়ে নিজের বিষয়বস্তুর দিকে মন দিতে হবে। অনেক সময় বক্তা মনে করেন, তাঁর উদ্বেগ সবাই বুঝে ফেলছেন। অথচ বাস্তবে শ্রোতা তা টেরই পান না।
এর পরও যদি চিন্তা আপনার মনের মধ্যে ঘুরঘুর করে, তাহলে বলে রাখি, শ্রোতা আপনার নার্ভাসনেস টের পেয়ে গেলেও দেখবেন বেশির ভাগ সময় তাঁরা আপনাকে উৎসাহই দিচ্ছেন।
হুট করে যদি কী বলছিলেন ভুলে যান বা মাথা ফাঁকা মনে হয়, আপনার কাছে সেটা দীর্ঘ সময়ের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়তো মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
এমনকি কিছুটা বেশি সময় হলেও শ্রোতা ভাববেন, আপনি থেমে বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন। তাই নীরবতাকে একদমই ভয় পাবেন না; বরং ধীরে ধীরে শ্বাস নিন এবং উপস্থাপনা চালিয়ে যান।
বক্তৃতা শেষে নিজেকে অভিনন্দন জানান। আপনার বক্তৃতা নিখুঁত না হলেও কোনো সমস্যা নেই। আমরা অনেক সময় নিজের ওপর যতটা কঠোর হই, শ্রোতা ততটা হন না।
বক্তৃতা শেষে আপনার যেসব জায়গা নিয়ে ভয় ছিল, তেমন নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা আদৌ ঘটেছিল কি না, তা ভেবে দেখুন। মনে রাখবেন, ভুল হতেই পারে, সেসবকে ভবিষ্যতের দক্ষতা উন্নত করার সুযোগ হিসেবে নিন।
এর পরও যদি আপনার দুশ্চিন্তার জায়গাগুলো কোনোভাবেই দূর করতে না পারেন, তাহলে এমন গ্রুপে যোগ দিন, যেখানে জনসমক্ষে কথা বলার সমস্যায় ভোগা মানুষদের সহায়তা করা হয়।
‘টোস্টমাস্টারস ইন্টারন্যাশনাল’ হলো তেমনই কার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান। অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি সারা বিশ্বে শাখা পরিচালনা করে এবং ভালোভাবে কথা বলা ও নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দেয়।
যদি শুধু অনুশীলনে ভয় কাটাতে না পারেন, তবে পেশাদার কারও সাহায্যের কথা ভাবতে পারেন। কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (সিবিটি) একটি দক্ষতাভিত্তিক চিকিৎসাপদ্ধতি, যা জনসমক্ষে কথা বলার ভয় কমাতে সাহায্য করে।
আরেকটি উপায় হলো চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনে নিজেকে শান্ত করার কোনো ওষুধ নেওয়া। তবে জনসমক্ষে বলার আগে অন্তত একবার সেই ওষুধ খেয়ে দেখে নিন, কীভাবে আপনার ওপর প্রভাব ফেলে।
জনসমক্ষে কথা বলার আগে নার্ভাস বা উদ্বিগ্ন হওয়া সাধারণ বিষয়। তবে এটি অনেক সময় আপনাকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে।
জনসমক্ষে কথা বলার ভয়কে বলা হয় ‘পারফরম্যান্স অ্যাংজাইটি’, যার মধ্যে ‘স্টেজ ফ্রাইট’ বা পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগও অন্তর্ভুক্ত।
তবে যদি কারও উদ্বেগ কেবল জনসমক্ষে কথা বলায় সীমাবদ্ধ না থেকে অন্যান্য সামাজিক পরিস্থিতিতেও প্রবলভাবে দেখা দেয়, তাহলে এটি ‘সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার’ বা সামাজিক ভীতি হতে পারে। এ অবস্থায় সিবিটি, ওষুধ অথবা উভয়ের মাধ্যমেই কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব।
সূত্র: মায়ো ক্লিনিক