পেলের কাছে পেলের চিঠি (দ্বিতীয় পর্ব)

গত ২৯ ডিসেম্বর মারা গেছেন ফুটবলের রাজা পেলে। ২০১৬ সালে ‘নিজের ছেলেবেলার উদ্দেশে’ নিজেই একটি চিঠি লিখেছিলেন তিনি। প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে প্রকাশিত সেই চিঠির শিরোনাম ছিল ‘লেটার টু মাই ইয়ঙ্গার সেলফ’। তিন পর্বে চিঠির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।

সান্তোসের জার্সিতে কিংবদন্তি পেলে
ইনস্টাগ্রাম

তোমার খেলা দেখে একদিন বাবা বলবে, ‘তুমি দু-তিনটা বাজে পাস দিয়েছ। কেন?’

বিরক্ত স্বরে তুমি বলবে, ‘কিন্তু বাবা, আমরা তো জিতেছি। ৪-১ গোলে জিতেছি।’

সে তোমাকে আবার বলবে, ‘তোমাকে দক্ষ হতে হবে। তুমি আরও ভালো করতে পারবে।’

তোমার বাবা ভীষণ কর্মঠ একজন মানুষ। একটা ম্যাচে সে পাঁচবার হেড দিয়েছিল। ব্রাজিলের জন্য সে সময় এটা ছিল ইতিহাস। তুমি যখন তোমার ১ হাজারতম গোলটা করবে, সেটা হবে পেনাল্টি কিক। পুরো বিশ্ব সেদিন তোমার সেই গোল দেখার জন্য থমকে যাবে। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থকেরাও উদ্‌যাপন করবে তোমার সেই গোল। দলমত–নির্বিশেষে স্টেডিয়ামে উৎসব শুরু হবে। সবাই তোমার ছবি তুলবে, তোমাকে মাথায় তুলে নাচবে। আর তখন বাবা এসে তোমার কানে কানে বলবে, ‘আমার পাঁচবার হেড দেওয়ার রেকর্ড কিন্তু ভাঙতে পারলে না!’

এরপর তোমরা দুজনই হাসিতে ফেটে পড়বে। তোমার বাবা এক বিশেষ ধরনের মানুষ। সে–ই তোমার ফুটবল খেলার একমাত্র কারণ। এমনকি ইনজুরিতে পড়ে বাবার খেলা বন্ধ হয়ে গেলেও তুমি তাকে সব সময় বিশ্বের সেরা ফুটবলার হিসেবে ভেবে যাবে। তুমি আজীবন তোমার বাবার মতো খেলোয়াড় হতে চাইবে।

বাবার মতো এক ম্যাচে পাঁচবার হেড দেওয়ার সুযোগ তুমি পাবে না। তবে তার চেয়ে বেশি গোল অবশ্যই তুমি করতে পারবে (১ হাজার ২৮৩টি গোল)। আর এভাবেই তুমি বিশ্বের কাছে হয়ে উঠবে ‘পেলে’।

পেলে? কে এই পেলে? তোমার নাম তো এডসন। মা–বাবা বিজ্ঞানী টমাস এডিসনের নামের সঙ্গে মিলিয়ে এ নাম রেখেছেন। এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো—আমি জানি, তুমি তোমার এই নামকে অনেক ভালোবাসো। এখনই যত পারো এই নামকে ভালোবেসে নাও। বেশি দিন আর এই নাম তোমার থাকবে না।

বাউরুতে এক দুর্দান্ত গোলকিপার আছে, নাম বিলে। একদিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের তুমি বলবে, ‘শুনেছিস, পেলে নাকি দারুণভাবে সেভ করে আমাদের জিতিয়ে দিয়েছে?’ বন্ধুরা তোমার কথা শুনে হেসে কুটি কুটি হবে আর বলবে, ‘আরে বুদ্ধু, পেলে না, বিলে ওর নাম।’ এর পর থেকে সব বন্ধু তোমাকে ‘পেলে’ বলে খ্যাপাতে শুরু করবে। শুরুতে নামটা শুনে ভীষণ রাগ হবে তোমার। একদিন তো এতই রেগে যাবে যে মারপিট বাধিয়ে দেবে। আর এ জন্য স্কুল থেকে দুই দিনের জন্য বহিষ্কারও করা হবে তোমাকে। মা এসব শুনে তখন বেশ আদর করবে তোমাকে। আর সেদিন থেকেই তোমার নাম আজীবনের জন্য ‘পেলে’ হয়ে যাবে।

তবে এডসন নামটা কিন্তু কখনো ভুলো না। সেই নাম আর নিজের ভেতরের সেই কিশোরকে আমৃত্যু জিইয়ে রেখো।

তোমার বয়স যখন ১৩ হবে, তখন থেকে বড় পরিসরে ফুটবল খেলতে শুরু করবে তুমি। তখন থেকেই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায় শুরু হবে। তোমার বাবার বাউরু ক্লাবের তরুণ দলের সঙ্গে প্রশিক্ষণ শুরু হবে তোমার। এখানেই তুমি প্রথম চাকরি পাবে, আয় করবে। তোমার প্রথম চাকরি হবে দলের জ্যেষ্ঠ খেলোয়াড়দের বুট জুতা পরিষ্কার করা। প্রতি জোড়া জুতার জন্য ১ বা ২ পয়সা পাওয়া যাবে। এই আয় খুব একটা বেশি নয়, তবে মোজার বদলে সত্যিকারের বল কেনার জন্য যথেষ্ট।

তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে অল্প বয়স থেকেই তুমি ভালো করতে থাকবে। ওই সময় তোমার জীবনে আসবে ওয়ালডেসার দ্য ব্রিটো নামের এক ভদ্রলোক। সান্তোস ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে পেশাদার জীবন শুরু করার পেছনে তার বিরাট অবদান থাকবে। তোমার মেধার ব্যাপারে জানতে পেরে সে বলবে:

‘পেলে, আমার বিশ্বাস তুমি একদিন অনেক ভালো একজন পেশাদার ফুটবলার হবে। তবে নিজেকে কোনো দিন সবার চেয়ে সেরা ভেবো না। নিজেকে ঈশ্বর ভেবো না। যদি প্রচুর আয় করতে শুরু করো, তাহলে সেখান থেকে কিছু ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রেখো। সিগারেট আর চকলেট কেনার পেছনেই নিজের সব আয় উড়িয়ে দিয়ো না। যত দূরেই যাও না কেন, নিজের ভেতরের বাউরুর ছেলেটাকে নিয়ে যেয়ো।’

এই কথাগুলো মনে রেখো। কারণ, সত্যি সত্যিই ১৫ বছর বয়সে তুমি পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করবে। যখন সান্তোস ক্লাবের লকার রুমে প্রথমবার ঢুকবে, দেখবে সতীর্থদের বুট জুতা সারি সারি করে সাজানো। মুগ্ধ হয়ে যাবে তুমি। সবাই বয়সে বড়, পরিণত খেলোয়াড়। আর তুমি ছোট শহর থেকে আসা এক কিশোর মাত্র। তুমি অবাক হয়ে তোমার জার্সির দিকে তাকাবে। দেখবে তাতে লেখা, ‘১০’। নিজের চোখকে বিশ্বাস হবে না। মনে মনে বলে উঠবে, ‘ও ঈশ্বর! এ আমি কোথায় চলে এলাম? কী করছি আমি এখানে?’ এই স্মৃতি আমৃত্যু তোমার সঙ্গে থাকবে।

আরেকটা মজার গল্প বলি।

তোমার বাড়ি থেকে সান্তোস অনেক অনেক দূরে। প্রথমে বাউরু থেকে পাঁচ ঘণ্টা ট্রেনে চড়ে সাও পাওলো শহরে আসতে হয়। এরপর আবার দুই ঘণ্টার বাসযাত্রায় আসতে হয় সান্তোসে। নিজের সঙ্গে তাই বই রেখো, এডসন। পুরো পথ শুধু ঘুমিয়ে পার করে দিয়ো না।

একদিন সান্তোসের বাসস্ট্যান্ডে বাবার জন্য তোমাকে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে দুপুরের রোদে গলা তৃষ্ণায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম হবে। তখন হাঁটতে হাঁটতে তুমি পৌঁছে যাবে একটা সমুদ্রসৈকতে। সাগরের স্বচ্ছ পানি দেখে তোমার চোখ চকচক করে উঠবে। সঙ্গে সঙ্গে ওই পানিতে হাত ডুবিয়ে পানি খেয়েও নেবে।

ইয়াক!

হ্যাঁ, ওই পানি নোনা লাগবে। সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে ফেলে দেবে। ভাববে, ‘কী সমস্যা এই পানিতে? এটা বিষাক্ত নাকি?’

এরপর জীবনে যতবার এই স্মৃতি মনে পড়বে, ততবার তোমার পেট ফেটে হাসি আসবে। বাউরুতে তো কোনো দিন তুমি সমুদ্র দেখোনি, সৈকত দেখোনি। কিন্তু সান্তোসে আছে নীল সাগর আর বিরাট সৈকত। প্রথমবারের মতো সমুদ্র তুমি এই সান্তোস শহরেই দেখবে। কিন্তু সাবধান এডসন, সমুদ্রের পানি খেতে যেয়ো না আবার!

(তৃতীয় পর্ব পড়ুন আগামীকাল)