এইচএসসির পর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নানা বিষয়ে পড়তে পারেন শিক্ষার্থীরা। প্রকৌশল, ব্যবসায় শিক্ষা নাকি কলা বা সামাজিক বিজ্ঞান—কোন বিষয় বেছে নেব? এমন দ্বিধায় যাঁরা আছেন, এই লেখা তাঁদের জন্য।

বি এম মইনুল হোসেন, অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আধুনিক সভ্যতা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর। সমাজের এমন কোনো ক্ষেত্র পাওয়া যাবে না, যেখানে প্রযুক্তির ছোঁয়া নেই। প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির নতুন নতুন ধারা যুক্ত হচ্ছে। এগুলোর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্যা সমাধান। সেটি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে তৈরি হওয়া সমস্যার সমাধান হোক, আর বিশেষায়িত কোনো সমস্যার সমাধান হোক। মনে রাখতে হবে, বাস্তব সমস্যা সমাধানের বিশাল এক হাতিয়ার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল।
পৃথিবীজুড়ে বর্তমানে যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চলছে, সেটির মূল ভিত্তিই হচ্ছে প্রযুক্তি। সারা বিশ্বে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল জানা মানুষের চাহিদা আছে। আমাদের দেশেও বাড়ছে। অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটাই এ ক্ষেত্রে বড় কথা নয়। নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলাটাই এখানে মুখ্য। বিশ্বের অনেক বড় বড় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নয়, কাজের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে চাকরি দেওয়া হয়।
আলাদা করে সব বিষয় বা দক্ষতার নাম বলা কঠিন। তবে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের নকশা প্রণয়ন, নির্মাণ ও রূপায়ণের দক্ষতা জরুরি। আর বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষ হয়ে ওঠার ভালো একটা মাধ্যম। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল বিষয়ে পড়ার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি দেশে এখন বেশ কিছু বিশেষায়িত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যুগোপযোগী আরও কিছু বিষয় চালু করেছে। এতে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়ার দারুণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয়ে পড়া বেশ ব্যয়বহুল। এগুলোকে নাগালের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। মেধাবৃত্তি, ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা ফি মওকুফের হার বাড়াতে হবে।
প্রথম দিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটারবিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি, তড়িৎ প্রকৌশলসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বেশি থাকলেও এখন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলসংক্রান্ত বেশ কিছু বিষয় চলমান। এর মধ্যে জৈবপ্রযুক্তিও আছে। বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ল্যাব ও গবেষণা সুবিধা আছে।
শিক্ষার্থী যে বিষয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক, বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে নির্দিষ্ট সেই বিষয় সম্পর্কে আলাদা করে খোঁজ নেওয়া উচিত। কারণ, ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকাস বা শক্তির জায়গা ভিন্ন হতে পারে।
খালেদ মাহমুদ, সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উচ্চশিক্ষার দুনিয়ায় অনেক পরিবর্তন আসছে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যারা ব্যবসায় শিক্ষায় পড়েছে, একসময় শুধু তারাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে ব্যবসায় প্রশাসন বা ব্যবসায় শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভর্তি হতো। পরে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরাও ভর্তি হতে শুরু করে। এখন বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে আসা অনেক শিক্ষার্থীও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের বিভিন্ন বিষয়কে পছন্দের শীর্ষ রাখছে।
বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ ডিগ্রি অর্জনের অনেক সুযোগ বাংলাদেশে আছে। এসব ফ্যাকাল্টিতে তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক ও ব্যবসায়িক দিক থেকে নানা বিষয়ে পড়ানো হয়। যারা ভবিষ্যতে করপোরেট দুনিয়ায় পা রাখতে চায়, উদ্যোক্তা হতে চায়, কিংবা হিসাবরক্ষক, ব্যবস্থাপক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চায়; তাদের জন্য এই বিষয়গুলোতে পড়ার অনেক সুযোগ আছে। আমরা একসময় মনে করতাম ব্যবসায় শিক্ষার বিষয় মানেই হিসাববিজ্ঞানের লম্বা দৈর্ঘ্যের একেকটা অঙ্ক, হিসাব-নিকাশ ইত্যাদি। এখন প্রযুক্তির বিপ্লব ব্যবসায় শিক্ষার দুনিয়াতে বিস্ময়কর পরিবর্তন আনছে বলা যায়। এখন প্রযুক্তির বহুমুখী ব্যবহার আছে বলেই আরও নানা কিছু জানতে হয় শিক্ষার্থীদের।
এখন ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীদের কোডিং কিংবা প্রোগ্রামিং জানতে হয়। ডেটা অ্যানালাইসিসসহ বিভিন্ন বিষয়ে হাতে–কলমে ক্লাসে পড়ানো হয়। শুধু তা–ই নয়, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় উপস্থাপনা, প্রেজেন্টেশন, কেস সলভিংসহ নানা বিষয়ে জানার সুযোগ আছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবসায় শিক্ষা সম্পর্কে জানতে হলে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে আরও নানা দক্ষতা শিক্ষার্থীদের অর্জন করতে হয়।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ব্যবসাবিষয়ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগও এখনকার ছেলেমেয়েরা গ্রহণ করছে। যাঁরা গণিত ভালো বোঝেন, বড় বড় হিসাব আর সংখ্যা নিয়ে আগ্রহ আছে, তাঁরা হিসাববিজ্ঞান বা ফিন্যান্স পড়তে পারেন। যাঁরা বিজ্ঞাপন বা পণ্য-সেবা নিয়ে ভাবতে পছন্দ করেন; উবার বা নেটফ্লিক্স কিংবা কোকাকোলা সারা বিশ্বে কীভাবে পণ্য প্রচার করছে—এসবের রহস্য জানতে চাইলে পড়তে হবে মার্কেটিং, আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিষয়ে। এ ছাড়া ব্যাংকিং, এন্টারপ্রেনিউরশিপ, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, ব্যবস্থাপনা, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টসহ নানা বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে। যাঁরা উদ্যোক্তা হতে চান, তাঁরাও ব্যবসায় শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয় বেছে নিতে পারেন।
তাওহিদা জাহান, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যাঁরা ভবিষ্যতে সৃজনশীলতা ও গবেষণাকে এক করে ক্যারিয়ার গড়তে চান; কলা অনুষদ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ কিংবা আইন অনুষদের বিষয়গুলো তাঁদের জন্য। সৃজনশীলতার মাধ্যমে সামাজিক নানা সমস্যার সমাধানের সময় এখন। উদ্ভাবনী ভাবনা দিয়ে যাঁরা এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন, উদ্যোগ নিচ্ছেন, তাঁরা সামাজিক বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে পড়তে পারেন।
এক যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বিষয় ও ক্যারিয়ার পছন্দের মনস্তত্ত্বে বেশ পরিবর্তন চোখে পড়ছে। একসময় উচ্চমাধ্যমিক শেষে প্রকৌশল, মেডিকেল, নয়তো ব্যবসায় শিক্ষার দিকেই নজর দিত শিক্ষার্থীরা। এখন কিন্তু নাট্যকলা, সংগীত, চলচ্চিত্র—এ ধরনের বিষয়ের প্রতিও ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহী হচ্ছে। কারণ, তারা জানে, ভবিষ্যতের যান্ত্রিক পৃথিবীতে মানবিক বোধ আর সৃজনশীলতার গুরুত্বই বরং বাড়বে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তোড়ে ভেসে শুধু আধুনিক প্রযুক্তির পেছনে ছুটলেই হবে না, মানবিকতা আর যান্ত্রিকতার মধ্যে ভারসাম্য গড়তে হবে। সে জন্য আমাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। দর্শন, মনোবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, ভূগোল, কিংবা ভাষাবিজ্ঞান—এসবের দিকে আরও বেশি নজর দিতে হবে। কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো ভবিষ্যতে আরও গুরুত্ব পাবে, সেটা এই সময়ে দাঁড়িয়ে অনুমান করাই যায়।
এখন দেখা যাচ্ছে, আইন অনুষদে পড়ে শিক্ষার্থীরা অনেকেই করপোরেট চাকরি করছেন। সামাজিক বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোতে কাজ করছেন কেউ কেউ। গবেষণার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ছে, এটাও আমাদের জন্য সুখবর। আইন, উন্নয়ন অধ্যয়ন কিংবা অর্থনীতির মতো বিষয়গুলো পড়ে দেশের বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়েই তাদের পাঠ্যক্রম সাজানো। তাই দেশে বসেও পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের কাজের সঙ্গে ওরা যুক্ত হতে পারছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রায় ৩০টির বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও আইন নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ আছে। বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য কিংবা মাদ্রাসার শিক্ষার্থী—সবারই আইন পড়ার অবারিত সুযোগ আছে।