মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো।
সংগ্রহকারী: রাবেয়া আক্তার, দশম শ্রেণি, এম এ বারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চুয়াডাঙ্গা (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়)
বর্ণনাকারী: মো. আলী আজগর, রেলপাড়া, চুয়াডাঙ্গা
সংগ্রহকারী ও বর্ণনাকারীর সম্পর্ক: নাতনি–নানা
১৯৭১ সালে ভারতের বিহার রাজ্যের চাকুলিয়ায় প্রথম ব্যাচে গেরিলা ট্রেনিং করি আমি। মাত্র ৪২ দিনের মাথায় গেরিলা ট্রেনিং শেষ করি আমরা। যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ি।
আমরা ছিলাম আলমডাঙ্গার ৮ নম্বর সেক্টরের অধীন। কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা ও ফরিদপুরের উত্তরাংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল এই সেক্টর।
আমি এই যুদ্ধে বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন গ্রাম, যেমন সাতগাড়ি, দিঘড়ি, মেছরদাড়ি, কুলচারা, ডোমবার চর ইত্যাদি গ্রামে হেঁটে রাতদিন পার করেছি।
একদিন শুনলাম, গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ হবে। তখন তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই। গিয়ে দেখি, আমার মা ভাতের চুলায় লাকড়ি দিচ্ছেন। এ অবস্থায় মাসহ আমরা তিন ভাইবোন অনেক কষ্টে মাঠঘাট পেরিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলার দলটা নামক জায়গার একটা স্কুলে গিয়ে আশ্রয় নিই।
ওখানে আমার বড় বোন অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে। পাশের বাড়ির কুয়া থেকে পানি উঠিয়ে তার মাথায় ঢেলে সুস্থ করে তুলি। এর পরের দিনগুলো ছিল অনেক কষ্টের। আমাদের চোখের সামনে অনেক গ্রাম, মাঠ, ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে শেষ করেছিল পাকিস্তানি সেনারা।
পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা সহ্য করতে না পেরে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সে সময় যোগ দিই বিভিন্ন অপারেশনে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা থানার অন্তর্গত নাটুকা রতনপুরে।
১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি। ওই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৪ জনকে খতম করি আমরা। আমাদের মধ্যে শহীদ হন আটজন।
এই আটজন শহীদ হলেন—
হাসান জামান (গোকুলখালী, চুয়াডাঙ্গা)
খালেদ সাইফুদ্দিন তারেক (পোড়াদহ, কুষ্টিয়া)
রওশন আলম (আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা)
আলাউল ইসলাম খোকন (চুয়াডাঙ্গা শহর)
আবুল কাশেম (চুয়াডাঙ্গা শহর)
রবিউল ইসলাম (মোমিনপুর, চুয়াডাঙ্গা)
কিয়ামুদ্দিন (আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা)
আফাজ উদ্দিন (দামুড়হুদা, চুয়াডাঙ্গা)
পরে চুয়াডাঙ্গার জগন্নাথপুর গ্রামের মানুষ রাস্তার পাশে দুটি কবরে চারজন করে আটজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ দাফন করেন। কালক্রমে এই আট মুক্তিযোদ্ধার কবরকে ঘিরেই স্থানটির নামকরণ হয় ‘আট কবর’।
এখানে পরবর্তী সময়ে একটি মুক্তমঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। পাশেই তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রহশালা। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাজধানী মুজিবনগর এখান থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে।
এখনো সেসব দিন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যা কোনো দিন ভোলার মতো নয়।