
প্রতি বাংলা নববর্ষের মতো ১৪৩২ সনেও দেশের ক্রীড়া, অভিনয়, গবেষণা, স্থাপত্যসহ নানা ক্ষেত্রের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে হাজির হয়েছে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। একঝাঁক উজ্জ্বল তরুণকে নিয়ে দুই পাতার আয়োজন করেছে এবার। এখানে পড়ুন তরুণ অর্থনীতিবিদ মাহতাব উদ্দিনের গল্প।
বাংলাদেশে অনেক তরুণ ও উদীয়মান অর্থনীতিবিদ আছেন, যাঁরা আমার ছাত্র বা ছাত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মাহতাব উদ্দিন নিঃসন্দেহে অন্যতম সেরা।
মাহতাব বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) গবেষণা পরিচালক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন।
প্রায় এক দশক ধরে একাডেমিক ও নীতি গবেষণার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত আছেন মাহতাব। তাঁর গবেষণার পরিধি ও বৈচিত্র্য প্রশংসনীয়। শ্রমবাজারের গঠন, কর্মসংস্থানের প্রবণতা, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, অভিবাসনের ধারা ও প্রভাব, প্রবাসী আয়ের ব্যবহার এবং অর্থনীতিতে এর ভূমিকা—এই সব বিষয়ে গবেষণায় তাঁর সুস্পষ্ট দক্ষতা রয়েছে। পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল, সামাজিক বৈষম্য হ্রাস এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য টেকসই সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরির মতো জটিল নীতিগত প্রশ্ন নিয়েও তিনি গভীর অনুসন্ধানী কাজ করেছেন।
এসব গবেষণার প্রেক্ষাপটে মাহতাব এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), এশিয়া ফাউন্ডেশন, একশনএইড, ব্রিটিশ ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), আন্তর্জাতিক উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র (আইডিআরসি), আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিসহ (ইউএনডিপি) একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পে তিনি গবেষক, বিশ্লেষক এবং নীতিমালা প্রণয়ন সহায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
একাধিক গবেষণায় মাহতাবের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। এসব অভিজ্ঞতায় মাহতাবের মধ্যে যে গুণাবলির পরিচয় আমি পেয়েছি, তা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। তাঁর অধ্যবসায় অবিস্মরণীয়—একটি জটিল গবেষণা প্রশ্নের গভীরে প্রবেশ করে, নানা তথ্যসূত্র সংগ্রহ করে এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুসংগত উত্তর বের করে আনার সক্ষমতা তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী। তাঁর বিশ্লেষণী দক্ষতা গভীর ও বহুমাত্রিক—তথ্য ও উপাত্তের ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে উন্নত পরিসংখ্যানপদ্ধতির প্রয়োগ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে তাঁর দক্ষতা লক্ষ করার মতো।
সবচেয়ে প্রশংসনীয় হলো মাহতাবের গবেষণার প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও অদম্য আগ্রহ। শুধু প্রথাগত দায়িত্ব পালনের মধ্যে তিনি সীমাবদ্ধ থাকেন না; বরং নতুন গবেষণা প্রশ্ন উত্থাপন, নীতির বাস্তবসম্মত সুপারিশ তৈরি এবং বিদ্যমান জ্ঞানের পরিধি প্রসারিত করার জন্য তাঁর নিরলস চেষ্টা স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি বাস্তব নীতিগত প্রেক্ষাপটের সঙ্গে গবেষণার সংযোগ স্থাপনে দক্ষতা মাহতাবকে অনন্য করে তুলেছে।
এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে মাহতাব শুধু একজন দক্ষ গবেষক হিসেবেই নয়, বরং একজন চিন্তাশীল নীতি-নির্মাণ সহযোগী হিসেবেও গড়ে উঠেছেন। তাঁর এ ধরনের দক্ষতা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও মাহতাবের পদচারণ প্রশংসনীয়। তিনি চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সম্মেলন ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান বিনিময় করেছেন।
মাহতাবের কর্মজীবন শুরু হয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগে (সিপিডি) প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট হিসেবে। এরপর ২০১৫ সালের জুলাই মাসে তিনি সানেমে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে যোগ দেন। পরে ২০১৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন এবং ২০২১ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। শিক্ষক হিসেবেও মাহতাব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর পাঠদান পদ্ধতিতে স্পষ্টতা, যুক্তিনিষ্ঠতা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার দক্ষতা চোখে পড়ে।
আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতেও মাহতাব অর্থনীতির গবেষণায় অবদান রাখবেন এবং শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেবেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে তাঁর গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি আশাবাদী।
ড. সেলিম রায়হান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক