বাংলাদেশের হয়ে ১০০ টেস্ট খেলার বিরল রেকর্ড গড়েছেন মুশফিকুর রহিম। পরিশ্রমী খেলোয়াড় হিসেবে তাঁর সুনাম আছে। পড়ালেখায়ও তিনি কিন্তু বেশ মনোযোগী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের এই সাবেক অধিনায়ক। মাঠের মুশফিককে আমরা সবাই চিনি, ক্যাম্পাসের মুশফিক কেমন? সেটাই জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠী আব্দুল্লাহিল মামুন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিল মুশফিকুর রহিম। তখন জাহাঙ্গীরনগরে কোনো খেলোয়াড় কোটা ছিল না, ফলে ওকেও ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধাতালিকায় স্থান পেতে হয়েছিল। ইতিহাস বিভাগের ৩৬তম ব্যাচের ছাত্র আমরা। সেই বছর বিভাগের ১০ জন শিক্ষার্থী সিট পেয়েছিল আল–বেরুনী হলে, মুশফিক তাদের একজন। কিন্তু আমরা সবাই থাকতাম মীর মশাররফ হোসেন হল বা এমএইচ হলে। মুশফিকও তার বিশ্ববিদ্যালয়–জীবনের বেশির ভাগ সময় আমাদের সঙ্গে এই হলেই কাটিয়েছে। ৩৫৮/বি ব্লকে ছিল ওর আনাগোনা। হালিম ভাইয়ের দোকানে সকালের নাশতা, ইকবালের দোকানে ভূরিভোজ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ ছাড়া হলের ক্যাফেটেরিয়া, বটতলায় প্রায়ই ওকে দেখা যেত। তবে বিশেষ পছন্দ ছিল শহীদ ভাইয়ের চানাচুর দিয়ে বানানো নুডলস আর ডিম বান। ক্যাম্পাস–জীবনে এক দিনই হলে রাত্রিযাপন করেছে মুশফিক, সেটাও এমএইচ হলে।
ক্রিকেট নিয়ে যত ব্যস্তই থাকুক না কেন, ক্লাসে মুশফিক ছিল মনোযোগী ছাত্র। শুধু পড়াশোনাতেই মনোযোগ দিলে হয়তো বিভাগের সেরা ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পেরোতে পারত। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ আমাদের ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু সে সময় চলছে ওয়ানডে বিশ্বকাপ, বাংলাদেশ দলের সঙ্গে মুশফিক তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। বিশ্বকাপ শেষে মুশফিকের সঙ্গে আমার প্রথম কথা হয় ফোনে। ভারত-বাংলাদেশ সিরিজ চলছে তখন, ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমার ফোন পেয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। ক্লাসে ফেরার আগ্রহও ছিল কণ্ঠে। তখন ভেবেছিলাম জাতীয় দলের খেলোয়াড় কি আর এত ক্লাস করবে?
কিন্তু না। মুশফিক খেলার বাইরে সময় পেলেই চলে আসত ক্যাম্পাসে। ক্লাস মিস দেওয়ার প্রবণতা ওর মধ্যে ছিল না। বরং খেলা না থাকলে টানা এক-দেড় মাসও তাকে ক্লাসে দেখা যেত। পারতপক্ষে পরীক্ষা মিস করত না। তবে খেলা ও অনুশীলনের ব্যস্ততার কারণে অনেক সময়ই টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারত না মুশফিক। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে পরে পরীক্ষা দিত। সেমিস্টার ফাইনালের দুটি পরীক্ষায় একবার অংশ নিতে পারেনি, বিশেষ ব্যবস্থায় পরে সেই পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল।
সারা দেশের মানুষ মুশফিককে একনামে চেনে। তাই বলে আমাদের সঙ্গে যে দূরত্ব রাখত তা নয়। বরং ক্যাম্পাসে এলে সবার সঙ্গে আড্ডা দিত। চায়ের দোকানে বসে পড়াশোনা-খেলাধুলা সরিয়ে রেখে মিশে যেত সিনিয়র-জুনিয়রের সঙ্গে। বন্ধুরা মিলে দূর-দূরান্তে ঘুরতেও গেছি আমরা। রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজারে যেমন ঘুরেছি, তেমনি জামালপুরে গিয়ে বন্ধুদের বাসায়ও থেকেছি। নিজের খেলোয়াড় পরিচয়কে কখনোই বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে আসতে দেয় না মুশফিক, সবার সঙ্গে ওর ব্যবহার অমায়িক। ওর অনেক ইচ্ছা ছিল ভারতে আমাদের বিভাগীয় সফরে যোগ দেবে। কিন্তু ঠিক সেই সময় জাতীয় দলের খেলা থাকায় আর হয়ে ওঠেনি।
মুশফিকের অন্যতম বড় গুণ ছিল সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা। কখনোই দেখিনি ক্যাম্পাসে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতে, ক্লাসে দেরি করে এসে শিক্ষকদের কাছ থেকে আলাদা কোনো সুবিধা নিতে। জাহাঙ্গীরনগরের বাকি সব শিক্ষার্থী যেভাবে ক্লাস করেছে, পরীক্ষা দিয়েছে—মুশফিকও তা-ই। একে তো ক্যারিয়ার, পরিবার সামলাতে হয়েছে, তার ওপর করোনার ধাক্কা—সব মিলিয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করা হয়নি আমার বন্ধুর। এমফিলের জন্য ভর্তি হয়েছিল, এখনো শেষ করতে পারেনি। যত দূর জানি, ওর ইচ্ছা আছে ক্রিকেটের ক্যারিয়ার শেষে পিএইচডি করার।
ক্যাম্পাস পেরিয়ে এলেও মুশফিক এখনো আমাদের একইভাবে মনে রেখেছে, যেমনটা আমরা ওকে মনে রেখেছি আমাদের একজন হিসেবে। মুশফিকের প্রতিটি অর্জন আমাদের গর্বিত করে, পরিবার-আত্মীয়স্বজনকে মাথা উঁচু করে বলতে পারি—ও আমার বন্ধু। যেমন বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে তার শততম ম্যাচ ও সেঞ্চুরিতে আমরা সবাই গর্বিত।
অনুলিখন: মৃণাল সাহা