চেকটা ভাঙাব, না বাঁধিয়ে রাখব, বুঝতে পারছিলাম না

মেলানি পার্কিন্স এখন টেক–দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী সিইওদের একজন। বিশ্ববিদ‍্যালয়ে পড়ার সময় খেলাচ্ছলে একটা সফটওয়‍্যার বানিয়েছিলেন। সেটিই পরে ক‍্যানভা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গ্রাফিকস ডিজাইন প্ল্যাটফর্মটির ওয়েবসাইটেই এর সহপ্রতিষ্ঠাতা মেলানি লিখেছেন শুরুর দিনগুলোর গল্প। পড়ুন নির্বাচিত অংশ।

মেলানি পার্কিন্স এখন টেক–দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী সিইওদের একজন
ছবি: উইকিপিডিয়া

সাল ২০০৮। আমি তখন পার্থের ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় পড়ি। পাশাপাশি একটা ডিজাইন প্রোগ্রামে ক্লাস নিই।

ক্লাস নিতে গিয়ে দেখলাম, ডিজাইন সফটওয়‍্যারের টুলগুলো কেমন যেন অগোছালো, জটিল। সব কটিই ডেস্কটপ নির্ভর। তার ওপর কাজ করতে অনেক সময় লাগে। তখন মানুষ ফেসবুক ব‍্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ফেসবুকটা সহজ বলেই মানুষ দ্রুত একে গ্রহণ করেছিল। অথচ ডিজাইনের নানা টুল শিখতে তখনো বছরব‍্যাপী প্রশিক্ষণ নিতে হতো। ডিজাইনের সফটওয়‍্যার যেন সহজ হয়, অনলাইন হয়, আর কয়েকজন মিলে যেন কাজ করতে পারে—এটুকুই ছিল আমার চাওয়া।

যদিও ব্যবসা, বিপণন, সফটওয়‍্যার উন্নয়নে আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তখন খুব সীমিত। নেই বললেই চলে। এইটুকু সম্বল করে এত বড় বড় কোম্পানিকে টপকে যাওয়ার ভাবনা তখন খুব অযৌক্তিক মনে হচ্ছিল।

তাই ঠিক করি, আইডিয়াটা আমি বিভিন্ন স্কুলের বার্ষিকীতে কাজে লাগাব। যেন অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাঁদের ডিজাইনের কাজগুলো সহজে করতে পারেন। আমার মা-ও একজন স্কুলশিক্ষক। তাঁকে দেখেছি, স্কুলের বার্ষিকী তৈরি করতে গিয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিতেন।

বয়ফ্রেন্ড ক্লিফকে (ওব্রেখট) ব‍্যবসায়িক পার্টনার, আর মায়ের ঘরটাকে অফিস বানিয়ে শুরু করে দিলাম আমাদের কার্যক্রম। প্রথম সফটওয়‍্যারটা বানাতে আমরা ঋণ নিলাম। সে সময় পার্থের প্রায় সব সফটওয়‍্যার কোম্পানির কাছেই গিয়েছিলাম। অধিকাংশ কোম্পানিই হয় বলেছে এটা একটা অসম্ভব প্রজেক্ট, নয়তো বলেছে এর জন‍্য অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা দরকার।

ক্যানভার প্রধান নির্বাহী মেলানি

শেষ পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়। গ্রেগ মিশেল পরিচালিত কোম্পানিটির নাম ইনডেপথ (বর্তমান নাম সিরেনা)।

আমরা আমাদের সফটওয়‍্যারের নাম দিয়েছিলাম ‘ফিউশন বুকস’। প্রথম সংস্করণটা যখন প্রাণ পেল, দেখে মনে হচ্ছিল যেন জাদু। তখন আমি আর ক্লিফ দুজনই শিক্ষার্থী। টুকটাক রোজগারের জন‍্য খণ্ডকালীন চাকরি করতাম। সকালে সন্ধ‍্যায় ছুটির দিনে যখনই সময় পেতাম, আমরা আমাদের সফটওয়‍্যার নিয়ে পড়ে থাকতাম।

প্রথম গ্রাহক পাই ২০০৮ সালের মার্চে। কী এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি! এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না। তাই অস্ট্রেলিয়ার আরেক প্রান্ত থেকে একজন যখন যোগাযোগ করল, খুব অবাক হয়েছিলাম।

সে লিখেছিল—‘হ‍্যালো, আমার স্কুলের জন‍্য যদি ২০০ বার্ষিকী (সর্বোচ্চ ২৫০) করতে চাই, কেমন খরচ পড়বে? আশা করছি দ্রুতই তোমাদের উত্তর পাব।’

১০০ ডলারের চেক পাঠিয়ে সে অর্ডারটা নিশ্চিতও করে ফেলল। আমাদের তখন খুশিতে পাগল হওয়ার মতো অবস্থা। চেকটা ভাঙাব, না বাঁধিয়ে রাখব, বুঝতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চেকটা ভাঙাতেই হলো; কারণ, টাকাটা আমাদের প্রয়োজন ছিল।

আমি আর ক্লিফ টুকটাক যা আয় করতাম, সবটাই সফটওয়্যারের বিপণনের পেছনে খরচ হয়ে যাচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন স্কুলে আমরা সরাসরি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। চিঠি ভাঁজ করা থেকে শুরু করে খামে ভরা, টিকিট লাগানো, এসব কাজে সাহায্য করেছিল পরিবারের সদস‍্যরা। গায়েগতরে খেটে সব করতে হয়েছে। কিন্তু এসবের মধ‍্য দিয়েই শিখেছি, কীভাবে এমন একটা পণ্য তৈরি করতে হয়, যেটার জন‍্য গ্রাহক পয়সা খরচ করতে রাজি হবে।

গ্রাহক খুঁজতে আমরা নানা জায়গায় ছুটছিলাম। এমনকি একটা শিক্ষা মেলায় অংশ নিতে সিডনিতেও গিয়েছি। সেখানে অংশগ্রহণকারীর চেয়ে প্রদর্শকের (এক্সিবিউটর) সংখ্যা ছিল বেশি। সুতরাং ওই চেষ্টাটা একেবারেই মাঠে মারা গেছে।

কোম্পানিতে আমরা প্রথম যাকে নিয়োগ দিই, তিনি একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। স্কুলবার্ষিকীর মৌসুমে, অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বরে কাজের চাপ খুব বেড়ে যেত। দিন রাত ২৪ ঘণ্টা চলত বার্ষিকী ছাপানোর কাজ। প্রত্যেক বছর আমরা আমাদের সফটওয়‍্যার একেবারে গোড়া থেকে আমূল বদলে ফেলতাম। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছিল, আমরাও ফিউশনকে তত সহজ, তত উন্নত করতে চেষ্টা করছিলাম। যা আয় করতাম, এই উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে সবই খরচ হয়ে যেত। তবে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে কাজের জন‍্য সরকার আমাদের কিছু কর মওকুফ করেছিল, সেটা খুব কাজে এসেছে। ন‍্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ব‍্যাঙ্কের কাছ থেকে পাওয়া ২০ হাজার ডলারের ঋণটাও ছিল বড় পাওয়া।

পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, এই ঠেকে ঠেকে শেখা সময়টার জন‍্য আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। যদি ব‍্যবসার গলিঘুপচিগুলো না চিনতাম, যদি গ্রাহকের চাহিদাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা না সাজাতাম, তাহলে ক‍্যানভা আজকের অবস্থানে কোনো দিন পৌঁছতে পারত না।