অধীর আগ্রহে তোমাদের ব্যর্থতা দেখার অপেক্ষায় আছি

‘হাঙ্গার গেমস’, ‘চার্লিস অ্যাঞ্জেলস’-এর মতো বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এলিজাবেথ ব্যাঙ্কস। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার ছাত্রী ছিলেন তিনি। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েই সমাবর্তন বক্তা হিসেবে ফিরে কী বললেন এই মার্কিন অভিনেত্রী? পড়ুন নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার সমাবর্তনে বক্তৃতা দিয়েছেন এলিজাবেথ ব্যাঙ্কস
ছবি: ইউটিউব থেকে

আমি একজন গর্বিত ‘পেন’ অ্যালামনাই। ১৯৯৬ ব্যাচ! ওয়েস্ট ফিলাডেলফিয়ায় আবার ফিরে এসে দারুণ লাগছে। ঐতিহাসিক ফ্র্যাঙ্কলিন ফিল্ডে দাঁড়িয়ে তোমাদের বিজয় উদ্‌যাপনটা আরও আনন্দের লাগছে।

ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় যাঁরা পড়তে আসেন, বেন ফ্রাঙ্কলিনের ভাস্কর্যের সঙ্গে ছবি তোলাটা তাঁদের জন্য রীতিমতো বাধ্যতামূলক। হ্যাঁ, এই বাধ্যতামূলক ছবি আমিও তুলেছিলাম। গিয়েছিলাম হিউস্টন হলে। আমাদের সময় ওখানে যেতে হতো মূলত ই–মেইল চেক করার জন্য। কারণ, তখন ল্যাপটপ বা ফোনের অস্তিত্ব ছিল না।

আমি জানি তোমরা মনে মনে বলছ, ‘কিন্তু এলিজাবেথ, তোমাকে দেখতে তো অনেক তরুণ দেখায়! তোমার তো ছোটবেলা থেকেই ই–মেইল থাকার কথা।’ না, আমি সেই ডাকযোগে চিঠি পাঠানো আমলের লোক। সেই সময়ে আমি কাউকে ছবি পাঠালে সেটা সত্যিই আমার ছবিই হতো। (হাসি)

ভালো কথা, আজও ই–মেইল অ্যাড্রেস নেই, এমন দুজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আমার মা-বাবা, যাঁরা এখানে উপস্থিত আছেন। শেষবার যখন এই মাঠে আমরা তিনজন একসঙ্গে এসেছিলাম, তখন আমার গায়েও তোমাদের মতো গ্র্যাজুয়েশনের টুপি আর গাউন ছিল।

আমি এখানে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করতাম। চেয়েছিলাম টিউশনের প্রতিটি পয়সা উশুল করে নেব। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা আদতে একাডেমিক ক্লাস থেকে নয়, বরং বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে। উদাহরণ দিই—আমি একবার এমন এক কঠিন শিক্ষকের ক্লাস নিয়েছিলাম, যেটা সপ্তাহে মাত্র এক দিন, শুক্রবারে হতো। শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম, ক্লাসও হতো কম। তাই একদিনও অনুপস্থিত হলে কোনো অজুহাত মানা হতো না। তাতে গ্রেড কমে যেত। এ নামত এ-মাইনাসে, এ-মাইনাস নামত বি-প্লাসে।

অবশ্যই, আমার লক্ষ্য সব সময় ‘এ’-ই ছিল। তো একবার কাজিনের বিয়ে সামনে, আমি আর পরিবার চেয়েছিলাম শুক্রবারে যাব। অধ্যাপকের কাছে অনুমতি নিতে গেলাম। তিনি বললেন, ‘সমস্যা নেই, তবে তোমার “এ” নেমে যাবে।’

কিন্তু আমি তো পরিবারকে নিরাশ করতে পারি না। বললাম, ‘সব পুষিয়ে দেব।’ আমাকে শাস্তি না দেওয়ার যত রকম কারণ দেখানো সম্ভব, সবই তাঁর সামনে উপস্থাপন করলাম। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্তে অটল। বললেন, ‘তোমার ইচ্ছা। তবে জীবনে যা-ই বেছে নাও না কেন, তার তো একটা ফল পেতেই হবে।’

আমার মনে হচ্ছিল, তিনি অসম্ভব শর্ত দিচ্ছেন। জিপিএ আর পরিবার—দুটোর মধ্য থেকে একটা বেছে নিই কীভাবে! কিন্তু আমার শিক্ষক খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিলেন। যেন একজন প্রাপ্তবয়স্ক আরেকজন প্রাপ্তবয়স্কের সঙ্গে আলাপ করছেন। আমার কাছে এই অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন।

আমি তখনো নিজেকে বাচ্চা ভাবতাম। হয়তো তোমাদেরও অনেকের এমনটা মনে হয়। কিন্তু তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘না, তুমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক। তোমার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে।’

এটা একজন তরুণকে বলার মতো বিরাট এক শিক্ষা—‘তোমার জীবনের নিয়ন্ত্রণ তোমার কাছে।’ আর হ্যাঁ, তুমি কোনো কিছুর অধিকারী জন্মসূত্রে নও। দ্বিতীয় কথাটা শুনতে অবশ্য একটু খারাপ লাগে।

হাঙ্গার গেমস, চার্লিস অ্যাঞ্জেলস-এর মতো বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এলিজাবেথ ব্যাঙ্কস

শেষমেশ আমি কাজিনের বিয়েতে গিয়েছিলাম, আর গ্রেডের ক্ষতি মেনে নিয়েছিলাম। পুরো পরিবার নিয়ে টেনেসিতে গাড়ি চালিয়ে গিয়েছিলাম। দাদি মাঝের সিটে বসে ছিলেন পাক্কা সাত ঘণ্টা। দারুণ সময় কেটেছিল। দাদি কিছুদিন পরেই মারা যান।

সেই কাজিনও আজ আর নেই। তাই আমি কখনোই সেই সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত হইনি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ স্বীকৃতি ‘সুম্মা কুম লডে’ পাইনি। কিন্তু বিশ্বাস করো, তাতে জীবনে খুব বেশি সমস্যা হয়নি।

এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে—আমাদের মূল্যবোধ অনেক সময় একটা আরেকটার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। তখন নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোই বুঝতে সাহায্য করে আমি আসলে কে, আর কিসে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই। এটাই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। শুধু বাথরুমের নালা থেকে নিজের চুল পরিষ্কার করাই বড় হয়ে যাওয়া নয় (যা অবশ্যই করা উচিত)।

জিপিএ নাকি পরিবার? সৃজনশীলতা নাকি নিরাপত্তা? বিশ্বস্ততা নাকি ব্যক্তিগত উন্নতি? ভালোবাসা নাকি টাকা?

তোমাদের চলার পথে এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এখনকার সবচেয়ে বড় বিভাজনটা অর্থনৈতিক। শিল্পী উইলিয়াম দা কুনিং একবার বলেছিলেন, ‘গরিব হওয়ার বড় সমস্যা হলো, এটা তোমার সমস্ত সময় কেড়ে নেয়।’ আমি এখানে পড়তে এসেছিলাম বৃত্তিসহ। প্রতিটা ধাপের জন্য আমাকে অনুদানের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।

একটা ভাঙাচোরা পুরোনো সাইকেল পেয়েছিলাম। সেটাকে মেরামত করে তিন বছর চালিয়েছি। মনে আছে গ্র্যাজুয়েশনের দিনে সাইকেলটা তালা না দিয়েই আরভিং রোডে রেখে এসেছিলাম। আমার লক্ষ্য ছিল খুব সরল—চাকরিযোগ্য হওয়া, আর ভালো বেতন পাওয়া। মানুষ যখন প্রশ্ন করে, কখন ঠিক করলাম অভিনেত্রী হব, আমি উত্তর দিই—যখন প্রথম অভিনয়ের জন্য টাকা পেলাম।

আমি কি এতে আগ্রহী ছিলাম? অবশ্যই। এতে কি আমার আত্মসম্মান আর আনন্দ এসেছিল? হ্যাঁ। কিন্তু আমি ছিলাম বাস্তববাদী। তবে এখানে পড়াশোনার সময় আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। বুঝতে শুরু করি, আমি আমার জীবনের নিয়ন্ত্রণে আছি।

আমি অধীর আগ্রহে তোমাদের ব্যর্থতা দেখার অপেক্ষায় আছি। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছ—তোমরা কখনো না কখনো ব্যর্থ হবে। তুমি যা চাইছ, সেটা ঠিকমতো না-ও পেতে পারো। কিন্তু সেটাই তোমার সবচেয়ে বড় সুযোগ—তুমি কী চাও সেটা বোঝার জন্য।

তুমি হয়তো বলবে, ‘না, এটা চাই-ই চাই।’ কিন্তু এই একমুখী দৌড়ে আশপাশের সব সুযোগ চোখ এড়িয়ে যায়। তাই প্রতিটি ব্যর্থতার সময় নিজেকে প্রশ্ন করো—আসলে তুমি কী চাইছ? টাকা? সম্মান? স্বাধীনতা? স্বীকৃতি?

শেষে বলব—তুমি ভুল করবে, আর সেই ভুল থেকে শেখার অধিকার তোমার আছে। কোনো ভুল তোমার আশা-স্বপ্ন ভেঙে দেবে না।

(ইংরেজি থেকে অনূদিত)