আগামীকাল বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে পাঠকের কাছে লেখা চেয়েছিল ‘ছুটির দিনে’। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন বিপুল পাঠক। নির্বাচিত একটি লেখা পড়ুন এখানে।

তমিজ উদ্দিন মাস্টারের আমি ছোট ছেলে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক হিসেবে অবসর নেওয়ার পরও আব্বার এই পরিচয়েই আমি পরিচিত। নিজেও কলেজের শিক্ষক হয়েছি, কিন্তু আব্বার মতো ‘মাস্টার’ হয়ে উঠতে পারিনি।
তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। তখনই আব্বার কিছু দায়িত্ব আমি নিজেই কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম! শার্ট ইন করার পর আব্বার প্যান্টের বেল্ট লাগিয়ে দেওয়া, আব্বার বাটা কোম্পানির ফ্ল্যাট জুতাটা মুছে দেওয়া, হিরো সাইকেলটা মুছে রাস্তা পর্যন্ত দিয়ে আসা। বিনিময়ে দৈনিক আমাকে দুই টাকা করে দিতেন আব্বা!
সাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন ২৪ কিলোমিটার পথ যাতায়াত করতেন আব্বা। স্কুল থেকে বাড়িতে আসার সময় মাঝেমধ্যে ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে আসতেন। মজার কোনো খাবার আনলে আমার আনন্দ আর ধরত না। ফলের মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই আম-কাঁঠাল নিয়ে আসতেন। রাতে দুধ দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় দুধের সর আমাকেই দিয়ে দিতেন। দুধভাত খুব একটা পছন্দ করতাম না। তবে আব্বা চাইতেন আমি একটু দুধভাত খাই। প্লেটে দুধ নেওয়ার পর আব্বা ইচ্ছে করেই নিজের প্লেটে ভাত নেওয়ার নাম করে আমার প্লেটেও একটু ভাত দিয়ে দিতেন।
কিন্তু সেই সুখের দিন একসময় ফুরিয়ে যায়। প্রাইমারি শেষে আমাকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, মামাবাড়ির পাশেই আমার স্কুল। সেখানে পাঠানোর আরেকটা কারণ, গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ানো। মামাবাড়িতেই থাকতেন সেই শিক্ষক।
মামাবাড়ি বেড়ানোর জন্য প্রিয় হলেও পড়াশোনার জন্য মোটেই আরামদায়ক জায়গা না। তা ছাড়া বেশি দিন বাড়ি ছেড়ে থাকাটাও আমার ধাতে নেই। তাই প্রতি বৃহস্পতিবার পায়ে হেঁটে ব্যাগ কাঁধে করে বাড়িতে চলে আসতাম। বাড়ি এলে আর যেতে মন চাইত না। প্রতি শনিবার মামার বাড়ি যাওয়া নিয়ে বকাঝকা করতেন আব্বা। মাঝেমধ্যে পিঠে বেতের বাড়িও পড়ত। একবার তো সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেললাম মামার বাড়িতে আর না! আব্বাকেও সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। আব্বা তো রেগে আগুন। অনেক মারলেন। কান্নাকাটি করে নমনীয় হলাম। পরে আমাকে নিতে সেই গৃহশিক্ষক এলেন। রিকশায় যাওয়ার সময় সবাই হাসাহাসি শুরু করল, কেউ কেউ বলল, ‘নতুন বউ নিয়ে যাচ্ছে!’
আব্বা ছিলেন খুব ধৈর্যশীল, সৎ ও পরিশ্রমী। আব্বা ছাত্রছাত্রীদের কাছে অনেক জনপ্রিয়। এমনকি সহকর্মীদের কাছেও। আমি এখন কলেজের প্রভাষক। কলেজে যোগ দেওয়ার খবরে আব্বা অনেক খুশি হয়েছিলেন। যেমন খুশি হয়েছিলেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর। নিজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েও অর্থের অভাবে ভর্তি হতে পারেননি। লজিং থেকে স্নাতক করেছেন। চাইতেন তাঁর সন্তান যেন কষ্ট না করে। বাবারা বোধ হয় এমনই হয়।