৪৯তম বিশেষ বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন রাজশাহীর মিতা খাতুন
৪৯তম বিশেষ বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন রাজশাহীর মিতা খাতুন

৪৯তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন মিতা, এ পর্যন্ত আসতে কত কাঠখড়ই না পোড়াতে হয়েছে তাঁকে

৪৯তম বিশেষ বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন রাজশাহীর মিতা খাতুন। এ পর্যন্ত আসতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীকে কত কাঠখড়ই না পোড়াতে হয়েছে। শুনুন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ–এর কাছে।

মিতা তখন খুবই ছোট। একদিন শুনলেন, তাঁর বাবা মাহাবুল ইসলাম হারিয়ে গেছেন। বাড়ির সবাই পাগলপ্রায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল মিতার বাবা ঢাকায় আছেন। রিকশা চালাচ্ছেন। বার্তাবাহকের মাধ্যমে মিতাদের চিন্তা করতে নিষেধ করে বলেছেন, ঢাকায় গিয়ে কী করবেন, কোথায় উঠবেন, কিছুই ঠিক ছিল না। তাই কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম কাপড়চোপড়ের ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে এখানে-সেখানে ঘুমিয়েছেন। তারপর রিকশা চালানোর সুযোগ পেয়েছেন।

মিতা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর বাবা একবারে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন। তাঁদের বাড়ি বাঘা উপজেলার চকনারায়ণপুর গ্রামে। এই গ্রামের বাজারেই পরে চায়ের দোকান দেন। সঙ্গে বিস্কুট-কলাও রাখেন। সেটি এখনো তাঁদের আয়ের একমাত্র উৎস। তাতে কিছুতেই সংসার চলে না। বাবা তাই বিভিন্ন এনজিওতে ঋণ করেন। মাসে মাসে সেই ঋণের কিস্তি টানেন।

না পাওয়ার আঘাত নিয়ে বড় হওয়া

প্রতিটি ক্লাসেই কিছু সহযোগী বই কিনতে হয়। কোনো দিনই সেই বই একসঙ্গে কেনা হয়নি মিতার। সময় নিয়ে একটার পর একটা করে কিনতেন। এ জন্য ক্লাসের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ভালো হতো না। শিক্ষকেরা নবম শ্রেণিতে ওঠার পর তাঁর এই সংকটের বিষয়টা বুঝতে পারেন। তখন থেকে তাঁদের সৌজন্য সংখ্যাগুলো সব দিয়ে দিতেন। ওই দুই বছর আর বই নিয়ে সমস্যা হয়নি। মিতার ভাষায়, ‘জীবনে প্রথম সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়েছিলাম নবম শ্রেণিতে ওঠার পর।

আমি ফার্স্ট হয়েছি। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই জানে, আমি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হব। বাড়িতে গিয়ে দেখি বাবার মুখ ভারী। বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে অনেক খরচ। আমাদের অত সামর্থ্য নেই।’

এ কথা শুনে মিতার মতো তাঁর শিক্ষকদের মনেও বিষাদের ছায়া নেমে এল। তাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আশাবাদী ছিলেন বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক সাজিদুল ইসলাম। মানবিক বিভাগের বই নিতে গেলে মিতাকে পরপর তিন দিন তিনি ফিরিয়ে দিলেন, যেন বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। শেষে মানবিকেই পড়তে হলো মিতাকে।

২০১৭ সালে বাঘার রহমতুল্লাহ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করলেন মিতা। নম্বর পেলেন ১১৯৪, মানবিক বিভাগ থেকে উপজেলার মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশের যেকোনো কলেজে ভর্তি হতে পারতেন কিন্তু এবারও আর্থিক কারণে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হলো স্থানীয় মোজাহার হোসেন মহিলা ডিগ্রি কলেজে। ২০১৯ সালে জিপিএ-৫ (১১৪১ নম্বর) পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। এবারও উপজেলার মধ্যে মানবিকে সর্বোচ্চ নম্বর মিতার।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ও বাধার মুখে পড়লেন মিতা। বললেন, ‘আমার মা (সেলিনা বেগম) অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছাটা তিনি জানতেন। তাই আমার এসএসসির স্কলারশিপের ১৬ হাজার টাকা দিয়ে দুটি ছাগল কিনে রেখেছিলেন। আমি জীবনে অনেক ‘‘না’’ শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যেন আমাকে আরেকটা না শুনতে না হয়, সেই জন্য মা এই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।’

এইচএসসির ফল প্রকাশের পর মিতার বাবা রাজশাহীতেই মেয়েকে ভর্তি হতে বললেন। কিন্তু শিক্ষকদের চাপাচাপি আর পরামর্শে মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মিতার শিক্ষকেরা চাঁদা তুলে তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সহযোগিতা করলেন।

মিতা বলেন, ‘আমাকে না জানিয়েই তাঁরা এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তখনকার ইউএনও শাহীন রেজাও সহযোগিতা করেছিলেন।’

শিক্ষকের শাড়ি পরে ভাইভা দিয়েছেন মিতা খাতুন

টিউশনিও একটা লড়াই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেন মিতা। শামসুন্নাহার হলে আবাসিক। ভর্তির পরই করোনা শুরু হলো। মিতা বাড়িতে চলে এলেন। বাঘাতেই শুরু করেন টিউশনি। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে তার নিচের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের পড়াতেন। করোনার বন্ধের পুরোটা সময় তিনি এই কাজ করলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় খুললে তিনি ঢাকায় গিয়েও টিউশনি খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে পড়েন শুনে কেউ আর টিউশনি দেয় না। অনেক চেষ্টার পরে একটা টিউশনির খোঁজ পেলেন ক্যাম্পাস থেকে বেশ দূরে। বেতন ৪ হাজার টাকা। কিন্তু প্রথম মাসের অর্ধেক টাকা যিনি টিউশনি জোগাড় করে দিলেন, তাঁকে দিতে হবে। আর কয়েক দিন পড়ে যদি শিক্ষার্থীর ভালো না লাগে তাহলে বাদ দেবে। এই শর্তেই রাজি হয়ে গেলেন। এক মাস পড়ে শিক্ষার্থী খুশি। শুধু তা–ই নয়, তাদের পরিবারের যত টিউশনি, সব পেয়ে যান মিতা। সংসার খরচে বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য তিনি তখন থেকে চারটি টিউশনি করেছেন।

মিতার ভাষায়, ‘হয় আমি ঋণের কিস্তি দিয়েছি, বাবা সংসার খরচ টেনেছেন, না হয় আমি সংসার খরচ টেনেছি, বাবা দোকান চালিয়ে কিস্তির টাকাটা দিয়েছেন। এভাবেই পড়াশোনা শেষ হতে যাচ্ছে।’

শাড়ির ব্যবস্থা আমার বান্ধবীরা করবে

৪৯তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষার আগে মিতা তাঁর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ফাতেমা রেজিনা ইকবালের সঙ্গে একটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলেন। কথায় কথায় জীবনের গল্পটা শোনেন তিনি। তারপর জানতে চাইলেন ‘তুমি কি শাড়ি পরে ভাইভা দিতে যাবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মিতা খাতুন

মিতার ভাষায়, ‘আমি বললাম, আমার শাড়ির ব্যবস্থা আমার বান্ধবীরা করবে। শুনে ম্যাম বললেন, ‘‘তুমি জানো তোমার ম্যামের কত শাড়ি!’’ ওই দিন রাত ১১টার দিকে ম্যাম তাঁর একজন স্টাফকে দিয়ে আমার জন্য একটা সুন্দর শাড়ি পাঠিয়ে দেন। আমি সেই শাড়ি পরে ভাইভা দিতে গেলাম।’

ভাইভা কেমন হয়েছিল জানা গেল ১১ নভেম্বর। এদিন ৪৯তম বিসিএস (বিশেষ) পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের জন্য মাত্র ১৫টি আসন ছিল এই বিসিএসে। এই ১৫ জনের একজন হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন মিতা। অনেক ‘না’কে ডিঙিয়ে অনেক বড় ‘হ্যাঁ’ জয় করে সেদিন বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন মিতা। প্রথমেই তাঁর মাকে ফোন করে বলেছেন, ‘মা, তোমার মেয়ে ক্যাডার হয়েছে।’

মেয়ের কথা শুনে নাকি মা শুধু কেঁদেছেন। মিতার ভাষায়, ‘আমার স্বপ্নটা মায়ের হয়ে গিয়েছিল। তাই মা ফোন পেয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। বাবা পাশে থেকে আর কোনো কান্না নয়, বললেন বটে। আসলে আমরা তিনজনই সেদিন শুধু কাঁদলাম।’

মিতাকে যাঁরা সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের কথা নানাভাবে বললেন তিনি। মিতারা দুই ভাইবোন। তাঁর ছোট ভাই মাঈম ইসলাম নবম শ্রেণিতে পড়ে। সে–ও ক্লাসে প্রথম। তার পড়াশোনার খরচ মিতাই বহন করেন। মেয়েটা তাঁর কাজের মাধ্যমে মানুষের সেবা করতে চান। আর মা-বাবাকে দিতে চান একটি উন্নত জীবন।