
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে লেখা আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভালোবাসার টক–ঝাল–মিষ্টি গল্প লিখে পাঠিয়েছেন পাঠক। কেউ লিখেছেন দুরন্ত প্রেমের গল্প, কেউবা শুনিয়েছেন দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়ার অনুভূতি। তেমনই একটি লেখা পড়ুন এখানে।
তখন আমি জার্মানির একটা টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ডেটা সায়েন্সে ব্যাচেলর করছি। বার্লিনের পথঘাট কিছুই চিনি না। শুধু ভার্সিটিতে যাই আর আসি। তার ওপরে এখানে ইংরেজির কোনো ব্যবহারই নেই বললেই চলে। ভার্সিটির নোটিশ বোর্ড থেকে রেস্তোরাঁর খাবার মেনু—সবই জার্মান ভাষায়। ক্লাস লেকচারটা ইংরেজিতে হয় বলে রক্ষে।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে যাই। তারপর লাইব্রেরিতে পড়াশোনা। এরপর রাতে সুপারমার্কেটে কাজ। জীবনটা যেন শুধু দায়িত্ব আর সংগ্রামের নাম। প্রতিদিন এই একঘেয়ে রুটিন।
এই সুপারমার্কেটেই লিয়ার সঙ্গে পরিচয়। আমার মতো পার্টটাইম কাজ করে। প্রাণবন্ত একটা মেয়ে। ইংরেজিটাও ভালোই রপ্ত করেছে। প্রথম প্রথম টুকটাক হাই, হ্যালো হতো। একদিন শেলফ গোছানোর সময় হুট করে পিছলে পড়ে যাই, আর লিয়া দ্রুত হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে ফেলে।
ইংরেজিতে পুরো বাক্য বলে, ‘লাগে নি তো? তুমি ঠিক আছ?’
বাংলা সিনেমায় হলে অবশ্য মেয়েটারই এভাবে পড়ার কথা। সে ক্ষেত্রে নায়ক এসে আলগোছে নায়িকাকে ধরে সম্ভাব্য পতন ঠেকাবে। কিন্তু জীবন তো আর সিনেমা নয়, বাঙালি পুরুষ আমি আকস্মিক ঘটনায় লজ্জাই পাই।
এর পর থেকে কথা বাড়তে থাকে। আমার দেশের শীতকাল, মানুষ সম্পর্কে জানতে চাইত ও।
বলতাম, ‘তেমন নয়, শুধু হালকা ঠান্ডা, অনেকটা শরতের মতো।’
একদিন বলল, ‘তাহলে এত ঠান্ডায় এখানে কীভাবে থাকো?’
মজা করে বললাম, ‘জার্মান মেয়েদের হাসি সুন্দর তো তাই শীত কম মনে হয়!’
লিয়া একটু লজ্জা পেল, কিন্তু মুচকি হেসে বলল, ‘এশিয়ানদের এই একটা ভালো গুণ, ফ্লার্ট করে কিন্তু ভদ্রতা বজায় রেখে!’
শুধু সুপারমার্কেট নয়, কাজ শেষে কফিশপে বসে গল্প করা, শপিং মলে ঘোরা, বার্লিনের ছোট ছোট ক্যাফেগুলোয় বসে শীতের সন্ধ্যা কাটানো—আমাদের বন্ধুত্ব কোথা থেকে যেন অন্য রং নিতে শুরু করে। বুঝতে পারছিলাম, লিয়া আমার জন্য বিশেষ কেউ হয়ে উঠছে।
কিন্তু আমার মনের এক কোনায় সব সময় একটা চিন্তা কাজ করত—আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। পড়াশোনা শেষ হলে কি আমি এখানেই থাকতে পারব, চাকরি পাব, নাকি একদিন সব ফেলে ফিরে যেতে হবে?
এক সন্ধ্যায় কাজ শেষে লিয়া আমাকে বলল, ‘তুমি কি সত্যিই এখানে থাকবে, নাকি একদিন চলে যাবে?’
জানালার বাইরে তাকিয়ে বললাম, ‘জানি না, লিয়া। আমি চেষ্টা করছি, লড়ছি। কিন্তু জানি না সব কেমন হবে।’
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর আমার হাতটা ধরে। সেদিন বুঝলাম, ভালোবাসা শুধু দুজন মানুষের সম্পর্ক নয়, একসঙ্গে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি।