
আরেকটু আগেই নিতে পারতাম সাক্ষাৎকারটা। গোল বাধল মিস ওয়ার্ল্ড অস্ট্রেলিয়া ও মিস ওয়ার্ল্ড নিউজিল্যান্ডের কারণে। ভারতের হয়দরাবাদে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন শেষে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ আকলিমা আতিকা যখন হোটেলে নিজের ঘরে ফিরছিলেন, তখনই তাঁর সঙ্গে দেখা এই দুই সুন্দরীর। তিন কন্যায় কিছুক্ষণ কথাটথা বললেন। হোয়াটসঅ্যাপে এই কারণ ব্যাখ্যাসহ সাক্ষাৎকার দিতে সামান্য দেরি হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করতে ভুললেন না আতিকা। (সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জিনাত শারমিন)
মিস ওয়ার্ল্ড অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে কী নিয়ে আলাপ করছিলেন?
আমরা বলাবলি করছিলাম, এখানে (হায়দরাবাদে) ১২০টি দেশের নারীরা আছেন, কিন্তু কোনো ধরনের টক্সিসিটি নেই। সবাই কত উদার, ভালো মনের মানুষ। সবাই সবাইকে অনুপ্রাণিত করছেন। একজন আরেকজনের নানা কিছু নিয়ে প্রশংসা করছেন। আবহটাই অন্য রকম, সবার মধ্যে একটা ইতিবাচক এনার্জি ভর করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে আপনাকে কী জিজ্ঞেস করেছিল?
আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, বাংলাদেশের কোন বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে। বলেছি, আমার প্রজন্ম। আমাদের দেশের তরুণেরা সত্যিই সেরা। আমরা জেনারেশনাল ট্রমা ভেঙে ফেলা প্রজন্ম। আমাদের মা-বাবা, পূর্বপুরুষেরা যে ট্রমা নিজেরা বহন করেছেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, আমরা সেটা করব না। আমরা সেই প্রজন্ম, যারা নিজেরা সেরে উঠব আর নিজেদের সেরাটা দেব।
কীভাবে সেরে উঠলেন?
আমার আত্মবিশ্বাস খুব কম ছিল। স্কুলে পরীক্ষায় সঠিক উত্তরটা লিখে, সেটা কেটে পাশেরজনেরটা দেখে ভুল উত্তর লেখা মানুষ ছিলাম। আমার মনে হতো, ও ঠিক লিখেছে; আমি যা লিখেছি, সেটাই ভুল। কলেজে ওঠার আগপর্যন্ত আমার মনে হয়েছে, আমি একটা অযথা মানুষ, আমার কোনো যোগ্যতা নেই, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তারপর কলেজে ওঠার পর বাড়ি ছাড়লাম। দেখা গেল, আমি যা-ই করি, বন্ধুরা প্রশংসা করে। ছবি আঁকতাম, গান গাইতাম, প্রচুর বই পড়তাম। এসবও যে একটা মানুষের গুণ বা যোগ্যতা, এটা আমাকে প্রথম কলেজের বন্ধুরা অনুভব করিয়েছিল। ধীরে ধীরে নিজেকে ভালোবাসতে শিখলাম। নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করলাম।
এর পর থেকেই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন?
হ্যাঁ, ২০১৫ সাল থেকে। যখন নিজে সেরে উঠলাম, অনুভব করলাম, আমার আশপাশের অনেকেই একই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের জানা নেই যে তাঁরা কত অসাধারণ। আমি হিউম্যান সাইকোলজির ওপর কোর্স করি। ব্যক্তিগতভাবে পড়াশোনা করি। এরপর চাইল্ড ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানে বিশেষ শিশুদের আঁকা ছবি দিয়ে আমরা পোশাক, ব্যাগ ইত্যাদি ডিজাইন করতাম। এরপর মিস বাংলাদেশ-ইন ট্রেনিংয়ের (এমবিআইটি) সঙ্গে যুক্ত হই। এখন ৬-১২ বছর বয়সী শিশুদের মা-বাবাদের সন্তান পালনবিষয়ক কোর্স করাচ্ছি। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে ‘হিলার’ হিসেবে প্রায় ৫০০ তরুণ-তরুণীর মনের কথা শুনেছি।
আপনার পরিবার সম্পর্কে বলুন...
আমার বাবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থেকেছি। মা গৃহিণী। বড় ভাই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, জার্মানিতে চাকরি করেন। আমি শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে ফ্যাশন ম্যানুফ্যাকচারিং নিয়ে পড়ছি।
মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ নির্বাচিত হলেন কীভাবে?
২০২৩ সালে যখন মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা হয়, সেবার বিজয়ী হয়েছিলেন শাম্মি ইসলাম নীলা। আমি ছিলাম প্রথম রানারআপ। আর আমি ফেস অব বাংলাদেশ হিসেবে ফেস অব এশিয়ার মূল পর্বে অংশ নিই। সেবার দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়ে মনে হয়েছিল, আমাদের আর আন্তর্জাতিক মডেলদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। একটাই পার্থক্য, আমরা মনে করি, ওরা বিদেশি, ওরা ভালো কাজ করছে। আমার সেই ছোটবেলায় পরীক্ষার অভিজ্ঞতার মতো। আমরা হয়তো ওদের চেয়েও ভালো করছি, কিন্তু আসলে জানি না যে আমরা কতটা যোগ্য। এ বছর যখন আজরা আপুকে (আজরা মাহমুদ) মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের লাইসেন্স দেওয়া হয়, তখন মূল প্রতিযোগিতা শুরু হতে আর সময় ছিল মাত্র ১০ দিন। তিনি মনে করেছেন, এ প্রতিযোগিতার জন্য আমিই সেরা।
আপনি তো তাহলে প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ই পাননি...
একদমই না। এত হুলুস্থুলে সময়টা গেছে যে গতকাল অনুভব করলাম, আমি মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি! হোটেলে এসে ঘরে ঢুকে দেখি, বালিশের গায়ে আমার নাম লেখা। কিন্তু গতকাল (১০ মে) শাড়ি পরে যখন রিহার্সাল করছিলাম, তখন হঠাৎ খেয়াল করলাম, শাড়িতে নেমপ্লেটে আমার নাম নেই। সেখানে লেখা ‘বাংলাদেশ’। এখানে আমিই বাংলাদেশ। ক্যামেরা ট্রায়াল চলছিল আর বারবার আমার চোখে পানি চলে আসছিল। এক হাতে শাড়ি সামলে বারবার আরেক হাত দিয়ে চোখ মুছছিলাম।