আম্মা আমার ফার্মগেট, আব্বা মতিঝিল

আগামীকাল বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে পাঠকের কাছে লেখা চেয়েছিল ‘ছুটির দিনে’। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন বিপুল পাঠক। নির্বাচিত একটি লেখা পড়ুন এখানে।

মা–বাবা ও সন্তানদের সঙ্গে লেখক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সেই কবে থেকে আব্বার কাছে মুখ ফুটে কিছু চাই না! সব চাওয়া আম্মার কাছে। যে চাওয়া আসলে আব্বার কাছে, সেই দাবিটাও করেছি আম্মার কাছে। ব্যাপারটা যেন গাজীপুর টু মতিঝিল ভায়া ফার্মগেট। আম্মা আমার ফার্মগেট, আব্বা মতিঝিল। মনের আলমারির সবচেয়ে ওপরের তাকটায় উঠে গেলেন আব্বা, আম্মা হয়ে উঠলেন নিত্যব্যবহার্য। যত কাজ সব আম্মা।

আব্বা আসলে কখনোই দূরে সরে যাননি। আব্বা মঞ্চের কারিগর। মঞ্চ তৈরি করে দিয়ে গ্রিনরুম থেকে মঞ্চায়ন উপভোগ করতে পছন্দ করেন। আব্বারা ১২ ভাইবোন। তাঁদের স্বামী-স্ত্রী, ছেলেপুলে আর আমাদের মধ্যমণি দিদুকে ঘিরে, ঈদে-চান্দে আমাদের দোতলা বাড়ি যখন গমগম করত, কী লাগবে না লাগবে, দায়িত্ব নিয়ে নীরবে সবকিছু করে দিতেন আব্বা।

আব্বার মধ্যে নিজেকে সব সময় একটু দূরে সরিয়ে রাখার, একটু আড়াল করে রাখার ব্যাপার আছে। তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে না পারার এটা একটা কারণ হতে পারে।

মনে আছে, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার সময় মগের পর মগ কড়া চা-কফি খেয়ে রাত যখন জেগে পড়তাম, তখন একপর্যায়ে এমন অবসাদে চলে যেতাম যে চাইলেও আর ঘুম আসত না। সকালে আম্মা মাথায় তেল দিয়ে দিতেন। আর আব্বা! জানালার পর্দাটা টেনে তার ওপর গায়ে দেওয়ার মোটা কাঁথাটা টাঙিয়ে দিতেন, এক ফোঁটা আলোও যাতে আমার চোখে না লাগে। মেয়ের জন্য সূর্যকে আটকে ঘরকে রাত করে রাখতেন। সন্ধ্যায় ডালিমের কোয়াগুলো খুলে বাটিতে করে পড়ার টেবিলে দিয়ে যেতেন আব্বা। একটু পর যখন এসে দেখতেন তখনো খাইনি, কিছু বলতেন না। বাটিটা নিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে চিপে রস করে গ্লাসে দিয়ে যেতেন।

ছোটবেলা থেকে আমার রান্নার শখ। তখন তো ইউটিউব ছিল না। খবরের কাগজের রেসিপি দেখে বিভিন্ন ধরনের রান্না করার চেষ্টা করতাম। এর আগ পর্যন্ত আমার রান্নার জ্ঞানে ছিল, যত বেশি মসলা দেওয়া যায় এবং কষানো যায়, মাংস রান্না তত মজা হয়। ‘পরিমাণ মতো’ শব্দটার বাতেনি তত্ত্ব তখনো আমার বুঝে আসেনি। ফলে রেসিপিতে যা–ই লেখা থাকুক, পাটায় যতটা জয়ফল, জয়ত্রী বেটেছি, সবটুকু দিয়ে মাংস মেখেছি। এরপর নির্দেশনা অনুযায়ী ময়দা দিয়ে পাতিলের মুখ আটকে চুলায় বসিয়েছি। এবার কাচ্চি বিরিয়ানি চেখে দেখার পালা। আব্বা খেয়ে বলছেন, খুব ভালো হয়েছে। মসলা সামান্য একটু বেশি হয়েছে, এটা কোনো ব্যাপার না। অথচ আমার নিজেরই খেতে গিয়ে বমি এসেছে। মনে হয়েছে, দলা ধরে মেসওয়াক টুথপেস্ট গেলার চেষ্টা করছি! কী করে তখন আব্বা ওই অখাদ্য অমন হাসিমুখে খেতেন, জানি না। কিন্তু সেই থেকে জানি, আব্বার মুখ থেকে হাল আমলের ‘মাই প্রিন্সেস’ না শুনলেও আমি কী ভীষণ রকমের প্যাম্পারড!

ফলে আজও বলি, জেলপেন ছাড়া আমি লিখি না। কারণ, আমি এক বাপের এক মেয়ে! আমি মুড়ি খাই না। কারণ, আমি এক বাপের এক মেয়ে। আমি অনেক কিছুই করি না। কারণ, আমি এক বাপের এক মেয়ে!

আব্বা বোধ হয় জানেনও না এসব। কিংবা কে জানে, হয়তো সবই জানেন। আব্বার জিন দিয়ে আব্বাকে যেমন আমি পড়তে পারি, আব্বাও নিশ্চয় আমাকে পড়তে পারেন। আব্বা নিশ্চয় জানেন, সারা পৃথিবীর সামনে এক বাপের এক মেয়ে বলে বড়াই করা মেয়েটার বাবা দিবসে বাবাকে একটা ফোন করতে কেমন জড়তা কাটাতে হয়, কতটা অস্বস্তি পেরোতে হয়!

আমার বাবা। আমার শান্তিপ্রিয়, পরিপাটি, মাথার ওপর ছাদ আর পাশের ঘরের নীরব শ্রোতা, কাউকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না করা মানুষটা কোনো দিন আক্ষরিক অর্থেই আমাকে কিছু করতে বলেননি। ঘরের কোনায় ময়লা দেখলে নিজেই ঝাড়ু নিয়ে এসেছেন। ‘আমাকে দাও,’ বললে বলেন, না, থাক থাক। শুধু প্রতিবার কথা শেষে, প্রতিবার বিদায় জানানোর সময় বলেছেন, ‘ভালো হয়ে থেকো।’

মুখে কিচ্ছুটি না বলে ব্যক্তিত্ব দিয়ে সবটুকু বুঝিয়ে দেওয়া মানুষটি আমার বাবা। আমার তরফ থেকে, বাইরের এই দূরত্বটুকুর আরেক নাম সমীহ।