কোরবানির গরু বিক্রি করতে আসার পথে দুর্ঘটনায় বাবা কোহিনূর শেখকে হারায় কিশোর আরিফুল ইসলাম। তারপর গ্রামে ফিরে বাবাকে দাফন করার পরদিনই রাজধানীর পশুর হাটে ছুটে এসে গরুগুলো বিক্রি করে সে। সেসময় আরিফুলের করুন গল্প প্রকাশ করে প্রথম আলো, ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কাল বাবা দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে আরিফুল।

আমার তখন কত বয়স মনে নেই। আব্বার সঙ্গে আমি আর আমার মেজ বোন (সীমা খাতুন) হাটে গিয়েছি। আব্বা আমাদের রসগোল্লা কিনে খাওয়ালেন। হাট থেকে একটা নতুন জামা কিনে দিলেন। পথে পানি ছিল। ফেরার সময় আব্বা আমাকে কাঁধে নিলেন। আর নতুন জামাটা আমার বোনের হাতে দিলেন। বাড়ি ফিরে জামাটা আর কোথাও পাওয়া গেল না। জামাটা মিষ্টির দোকানে রেখে এসেছে, নাকি হাটের অন্য কোথাও ফেলে এসেছে, নাকি পানি পার হওয়ার সময় তার হাত থেকে পড়ে গেছে, কিছুতেই আমার বোন মনে করতে পারল না। বাবা খুব মন খারাপ করলেন। বোনকে বকাবকি করলেন। বাবার সঙ্গে একবারে ছোটবেলার এ স্মৃতিটাই মনে আছে।
বড় হতে হতে আরও কত স্মৃতি জমা পড়ল। আব্বা নদীতে মাছ ধরেন। আমি তাঁর জন্য সকালে খাবার নিয়ে যাই। এত বড় নদীতে আব্বা কোথায় মাছ ধরেন, পাড় থেকে বোঝা যায় না। এ জন্য নদীর পাড়ে গিয়েই ‘আব্বা, আব্বা’ বলে ডাকতাম। এক দিক থেকে ডাকতে ডাকতে আরেক দিকে যেতাম। ডাক শুনে একসময় মাঝনদী থেকে পাড়ে চলে আসতেন আব্বা।
বড় হওয়ার পরে যখন ফোন হলো তখন নদীর ঘাটে গিয়ে আর ডাকতাম না, আব্বাকে ফোন করতাম। আর মাছ মারা শেষ হলে আব্বা যখন নদী থেকে উঠে আসতে চাইতেন তখন আমাকে ফোন করে ডাকতেন। আমি জালগুলো মাথায় করে নিয়ে আসতাম। জালের ওজন ছিল ১৫ কেজির মতো। আমি জালটা মাথায় নিলে আব্বার বোঝাটা কমত।
কিন্তু আব্বা প্রতিদিন বলতেন, ‘তোমাকে আমার মতো মাছ মারতে হবে না, তুমি লেখাপড়া শেখো, তোমাকে অন্য কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশ পাঠাব।’ পড়াশোনা না করলে বকাবকি করতেন।
কোনো দরকারে আব্বার কাছে বেশি টাকা চাইলে এক চাওয়ায় কোনো দিন দিতেন না। তখন আমার বড় বোন (আমেনা খাতুন) আর মেজ বোন আমার পক্ষ হয়ে বাবাকে ফোন করে তদবির করত। তিন বছর আগে মোবাইল কিনতে চাইলাম। কোরবানির হাটে গরু বিক্রি করে আব্বা টাকা নিয়ে এলেন। আব্বা কিছুতেই ফোন কিনে দেবেন না। বোনদের ফোন করলাম। বোনেরা আব্বাকে বুঝিয়ে বলল। শেষে আব্বা আমাকে ১৮ হাজার টাকা দিলেন। ফোন কিনতে গেলাম বাঘায়। পছন্দ হলো ২০ হাজার টাকার মোবাইল। আমি মোবাইল না কিনে বাড়িতে চলে এলাম। আব্বা বললেন, ‘১৮ হাজার টাকা দিতে পারছি আর বাকি টাকা দিতে পারুম না? যা, ফোন নিয়ে আয়।’
আব্বার সঙ্গে শেষ স্মৃতিটা আমি আর কোনো দিন ভুলতে পারব না। এবার আমাদের তিনটা গরু। ঢাকার বছিলায় হাটে যাওয়ার জন্য সকাল নয়টায় বাড়ি থেকে বের হলাম। বাড়ি থেকে শিমুলতলার ঘাট সাত কিলোমিটার। কিন্তু সকালে ঘাটে গিয়ে লাভ হলো না, প্রথম গাড়িটা অন্য ব্যাপারীরা নিয়ে নিল। আমরা পরের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। দ্বিতীয় গাড়িটা এল দুপুর ১২টার দিকে। কিন্তু ওটা পাথর টানা ট্রাক। গরু নেওয়ার ট্রাক আলাদা, দড়ি বাঁধার জন্য মাঝখান দিয়ে মুখ থাকে। পাথরের গাড়ি সে রকম নয়। ওই ট্রাকও বাদ দিতে হলো। ট্রাকে উঠতে উঠতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল। আব্বা গরুর সঙ্গে ট্রাকের পেছনে থাকলেন আর আমি ট্রাকের মাথার ওপর উঠে বসলাম। লাইট ছিল না। বারবার আব্বাকে বলছিলাম, একটা লাইট কেনেন। আব্বা আমার ওপর বিরক্ত হয়ে বলছিলেন, ‘তোমাকে এত মাতব্বরি করতে হবে না।’
অন্ধকারের মধ্যেই আব্বা গরুর সঙ্গে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। টাঙ্গাইলে গিয়ে ট্রাক থামল। পেছন দিক থেকে একটা ট্রাক এসে আমাদের ট্রাকটাকে মেরে দিল। সারা রাস্তা আমার ফুফাতো ভাই আবদুল মোত্তালেব আমার হাত ধরে ছিল, যাতে ট্রাকের ওপর থেকে পড়ে না যাই। আর যখন পেছন থেকে ট্রাক এসে ধাক্কা দিল, আমরা দুই ভাই ছিটকে গরুর মাঝখানে পড়লাম। আমাদের ওপরে পড়ল গরুর জন্য নেওয়া ৪০০ আঁটি খড়।
আমরা সবাই আছি, আমাদের কারও কিছু হয়নি, কিন্তু আব্বা আর নেই। (অনুলিখিত)