সদ্যই বাবাকে হারিয়েছেন কেউ, কেউবা সেই শৈশবে, কারও বাবা আছেন বৃক্ষের মতো ছায়া হয়ে। তবে সবার বেড়ে ওঠায় মিশে আছে বাবার আদর, শাসন, অনুপ্রেরণা। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বাবা দিবস। সেই হিসাবে কাল বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে ছাপা হয়েছে বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কয়েকজন সন্তানের লেখা। এখানে তেমনই একটি লেখা।

বৈশাখ এলেই আমার পৃথিবীতে এক অদ্ভুত অস্থিরতা নামে। চারপাশ আনন্দে মুখর হয়ে ওঠে, রঙে রঙে রঙিন হয়ে ওঠে শহরের প্রতিটি কোনা। অথচ আমার ভেতরের শহরটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। কিছুই আর টানে না—না উৎসব, না মুখরতা, না নতুনের গান।
কারণ, এ বৈশাখেই ঠিক ১০ বছর আগে তুমি চলে গেলে, আব্বু। বৈশাখ আর আমার কাছে শুধু ঋতু নয়, এক অপূরণীয় শূন্যতার স্মারক।
শীতে যখন গোরস্তান মোড়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, দেখি ঘাসে শিশির জমে আছে। মনে হয়, এত দিনে তুমি হয়তো ঘাস হয়ে গেছ। শিশির জমা ঘাসই কি তুমি! হালকা ঠান্ডা যে বাতাসটা ওইখান থেকে আমাকে স্পর্শ করে, মনে হয় সেটা তোমার স্পর্শ।
আজকাল মধ্যরাতে প্রায়ই ঘুম ভেঙে যায়। বুকের মধ্যে হালকা একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। তীব্র এক হাহাকারে মোড়া ব্যথা। কত কী যে মনে হয় তখন! মনে হয়, আমি সবাইকে ভালো রাখার মাধ্যমে ভালো থাকতে চেয়েছি; কিন্তু আমি নিজে কারও হতে পারিনি। আমি শুধু আমারই হয়েছি।
মনে পড়ে, খুব অল্প বয়সে যখন এক হাতে অনেক কিছু সামলাচ্ছিলাম, হতাশা আমাকে একদম জেঁকে ধরেছিল। তুমি তোমার প্রিয় মোটরসাইকেলে করে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে। কোনো গন্তব্য থাকত না, শুধু থাকত কথা আর তোমার সেই আশ্বস্ত কণ্ঠ, ‘জীবনের পথ ফুলে ছাওয়া নয়, কাঁটায় ভরা। তুই এই কাঁটাগুলো নিজের মতো করে সরিয়ে রেখে হেঁটে যাবি গন্তব্যে।’
তুমি বলতে, আমাদের মতো স্বচালিত আর গভীর অনুভবের মানুষগুলো একা হাঁটে, একাই কেটে নেয় নিজের পথ।
আজ আমি সে পথেই হাঁটছি। হয়তো একটু ক্লান্ত, হয়তো অনেকটা একা, কিন্তু থামিনি। নিজের সহনশীলতার ওপর বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলেছি। যখন খুব ভেঙে পড়ি, ড্রয়ার থেকে তোমার আংটিটা পরে থাকি আঙুলে। তোমার লেখা চিঠিগুলো বারবার পড়ি। তোমার প্রিয় বইগুলো ছুঁয়ে দেখি, তোমার প্রিয় গানগুলো চলে প্লে লিস্টে। মনে হয়, এই তো তুমি।
তোমার ব্যবহৃত আতরের গন্ধেও তোমাকে খুঁজি। বছর বছর ধরে সেই একই আতর কিনি। তোমাকে যখন খুব বেশি মিস করি, ওই আতর মেখে শ্বাস নিই গভীর করে। তখন সেই সুগন্ধটা আর মধ্যরাতে আমার বারান্দায় শিরশির করে আসা ঠান্ডা বাতাসটার ছোঁয়ায় মনে হয়, তুমি ঠিক পাশেই আছ, গল্প শুনছ আমার।
আব্বু, তুমি শিখিয়েছিলে জীবনের অর্থ কখনো সহজ পথে খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করে হারিয়ে গিয়ে। কষ্ট পুষে রাখতে নেই, এগিয়ে যেতে হয়। কারণ, জীবন কারও জন্য অপেক্ষা করে না। তুমি বলেছিলে, নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়; সাহস লাগে। আমি সেই সাহসটুকু তোমার কাছ থেকে পেয়েছি।
আমার জীবনটা সহজ ছিল না, তুমি জানো। কিন্তু তুমি ছিলে আমার একমাত্র নীরব শক্তি। আজও আছ। হয়তো শারীরিকভাবে অনুপস্থিত, কিন্তু মানসিকভাবে শক্ত হয়ে আছ আমার প্রতিটি পদক্ষেপে।