
নাটোরের কবি অলোকা ভৌমিকের বইয়ের সংখ্যা ১৫। মারা যাওয়ার আগে ভিটাটুকুও বিক্রি করে যান তাঁর সংসারবিমুখ স্বামী। এর পর থেকে নিঃসন্তান কবিকে মায়ের যত্নে আগলে রেখেছেন এই ভিটার মালিক হামিদা বেগম। তাঁর জন্য আলাদা করে রান্না করেন, বইমেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিকে নিয়ে ছোটাছুটিও তিনিই করেন।
দরজা খোলাই ছিল। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল, ঘরের ভেতর একজন বয়স্ক মানুষ শুয়ে আছেন। কাছে গিয়ে বুঝলাম, ইনিই অলোকা ভৌমিক। ১৪ জুন তাঁকে দেখতেই নাটোরের বড়াইগ্রামের তিরাইলে যাওয়া। অতিথি এসেছে বুঝে অলোকা ভৌমিক বারবার বলছিলেন, ‘বসুন আপনারা।’
এরপরই ডাকতে থাকলেন, ‘হামিদা, ও হামিদা, হামিদা রে...’
কার কাছ থেকে খবর পেয়ে মিনিট পাঁচেকের মাথায় দৌড়াতে দৌড়াতে এলেন হামিদা বেগম। তাড়াতাড়ি পাশের ঘর খুলে চেয়ার বের করে দিলেন। অলোকা ভৌমিককে বসার ঘরে নিয়ে আসতে একটু সময় নিলেন। কারণটা একটু পরই বোঝা গেল। কবিকে একটি পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসিয়ে দুজন মিলে উঁচু করে নিয়ে এসে আমাদের সামনে বসালেন। তখন বোঝা গেল, কবি আসলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তাঁর এক হাত, এক পা অচল। আর এ কারণেই তখন উঠে আসতে পারছিলেন না, শুয়ে শুয়ে কথা বলছিলেন। কথা বলার সময় কিছুক্ষণ পরপরই তাঁর মাথার কাপড় ঠিক করে দিচ্ছিলেন হামিদা। খবর পেয়ে ছুটে এলেন হামিদার স্বামী ইয়াদ আলী মণ্ডল।
হামিদা বললেন, ‘ডাব পেড়ে আনো।’
ঘামতে ঘামতে ইয়াদ আলী গাছ থেকে দুটো ডাব পেড়ে এনে কেটে দিলেন। এক প্লেট পাকা আম কেটে সামনে রাখলেন হামিদা।
কবি অলোকা ভৌমিকের ছাপা বইয়ের সংখ্যা ১৫। আরও ৮টির পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত আছে। তাঁর বয়স এখন ৭৯ বছর। সব বই মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন কবি। বাড়িতে পাওয়া গেল ছয়টি বইয়ের কপি—ছোট বড় কবিতা, অতৃপ্ত, সনাতন, লেখকদের স্মৃতিকথা, অমৃত ও উদয়ের পথে। অলোকা ভৌমিক বললেন, ‘বই কি ঘরে রাখার জিনিস? মানুষকে পড়তে দিয়েছি।’
অলোকা ভৌমিকের বাবা ঈশ্বর জ্যোতিচন্দ্র সরকার ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। গৃহস্থালি কাজে অসুবিধা হয় বলে মেয়েকে স্কুলে যেতে দিতেন না মা। বাবা তার কোনো প্রতিবাদ করতেন না। স্কুলে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করলে মা বলতেন, ‘আজ থাক মা, কাল যেয়ো।’ অলোকার ভাষায় ‘সেই কাল কালই হয়ে গেল।’
রাতের বেলায় বাবার কাছে শিশুশিক্ষার বই নিয়ে বসলেও বড় ভাই পরিমল সরকার বলতেন, ‘ওঠ, মায়ের কাছে যা, রান্না শেখ। স্বামীর বাড়িতে রান্না করেই তোদের খাওয়াতে হবে।’
একদিন একটি কবিতা লিখে বড় ভাইকে দিতে গেলেন অলোকা। বড় ভাই কাগজটা হাতেও নিলেন না। বাধ্য হয়ে অলোকা কবিতাটি নিজেই পড়ে শোনালেন। শোনার পরে ভাই বললেন, ‘ভালোই তো হয়েছে রে।’
এরপর বড় ভাইয়েরও চিন্তা বদলাল। বাগাতিপাড়ার তমালতলা পাঠাগার থেকে অলোকার জন্য বই নিয়ে আসতে শুরু করলেন। একটা পড়া হলে ফেরত দিয়ে আরেকটা নিয়ে আসতেন। পরে একসঙ্গে চার-পাঁচটা করে নিয়ে আসতেন। অলোকা সেসব পড়তেন। এভাবেই স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠেন অলোকা।
১৯৬৬ সালে বড়াইগ্রামের তিরাইল গ্রামের বিশ্বনাথ ভৌমিকে সঙ্গে বাগাতিপাড়ার অলোকার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর হয়ে যান অলোকা ভৌমিক। বিশ্বনাথ ছিলেন বাউন্ডুলে প্রকৃতির মানুষ। কাজকর্ম করতেন না। পৈতৃক জমি বিক্রি করে চলতেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গেলে আর কিছুর খেয়াল থাকত না। কোনো দিন রাতে বাড়ি ফিরতেন, কখনো আবার ফিরতেনও না। ভাঙা বেড়ার ভাঙা ঘরে একলা ভীষণ ভয় করত অলোকার। এ থেকে বাঁচতে কম খেয়ে চাল কেনার পয়সা বাঁচিয়ে কাগজ-কলম কিনে রাত জেগে লিখতে শুরু করলেন তিনি। লেখার মধ্যে ডুবে গেলে আর জগতের কোনো খেয়াল থাকে না।
এই দম্পতির একটি সন্তান হয়েছিল, মৃত; পরে আর কোনো সন্তান হয়নি। এ অবস্থা দেখে দ্বিতীয় বিবাহ করেন স্বামী। তখন অলোকা ভৌমিক তাঁর ভাইয়ের বাসায় চলে যান। কিন্তু ছয় মাস পরে স্বামী গিয়ে সরাসরি অলোকার পায়ে ধরেন। অলোকাও আর ‘না’ করতে পারেননি। ফিরে আসেন স্বামীর সংসারে।
বিশ্বনাথ ভৌমিক আগের মতোই জমি বিক্রি করে চলেন। এভাবেই একসময় সব জায়গাজমি বিক্রি করে শেষ করে দেন। সর্বশেষ বাড়ির ভিটা বিক্রি করে দেন হামিদা বেগমের বাবার কাছে। তিনি এই জমি হামিদার মায়ের নামে লিখে দেন। হামিদার মা-বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর ভাইয়েরা জমিটা হামিদার নামেই লিখে দেন।
বছর ১৫ আগে বিশ্বনাথ ভৌমিক মারা যান। একাই সেদিন বাড়িতে কাঁদছিলেন অলোকা ভৌমিক। তখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান হামিদা বেগম।
৪০ বছর বয়সী হামিদাই এখন নিঃসন্তান অলোকা ভৌমিককে মায়ের মতো করে আগলে রেখেছেন। তাঁর জন্য আলাদা করে রান্না করে দেন। কবির প্রতি হামিদা বেগমের শ্রদ্ধা ও যত্নআত্তি দেখে মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের রতনের কথা, ‘বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না, সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল।’
প্রতিবেশী সম্পর্কে ‘বৌদি’ বলে সম্বোধন করলেও অলোকা আসলে হামিদার জননীর পদ অধিকার করে নিয়েছেন। আর সব হারিয়ে কবি অলোকা ভৌমিক যেন একটা মেয়ে পেয়েছেন।
অলোকা ভৌমিকের ভাতিজা প্রদ্যুৎকুমার সরকার তাঁর পিসির লেখা বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় অলোকা ভৌমিকের প্রথম বই উদয়ের পথে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ১৫টি বই প্রকাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। পিসির হাতখরচের জন্য প্রতি মাসে চার হাজার টাকা দেন প্রদ্যুৎ। আর বইমেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বইয়ের প্রকাশকের কাছে কবিকে নিয়ে ছোটেন হামিদা বেগম।
হামিদা বলছিলেন, ‘বইপত্র যা প্রকাশ হইছে, স্বামীর মৃত্যুর পরেই হইছে। আমি তাঁকে পাবনায় প্রকাশক মানিক মজুমদারের কাছে লিয়্যা যাই। বইমেলায় লিয়্যা যাই। একবার নাটোরের কানাইখালি বইমেলায় লিয়্যা গেলাম। অতিথিরা কেউ আসেনি দেখে বৌদি কাঁইদতে লাইগল। আমি বুঝালাম, আপনি কাইন্দেন না, একটু ধৈর্য ধরেন। সন্ধ্যার দিকে মাঠ ভরে গেল। ডিসি আসলেন। বই দেখে বললেন, “আমরা তো জানি না যে এখানে এত বড় একজন লেখক আছেন। এত বই প্রকাশিত হয়েছে।” তারপর বাসায় আসলেন, চার লাখ টাকার একটা ঘর তৈরি করে দেওয়ার ঘোষণা দিলেন।’
সেই ঘরে বসেই কথা হচ্ছিল। বয়স আর অসুস্থতার কারণে চেহারা ভেঙে গেছে কিন্তু এখনো অলোকা ভৌমিকের অভিজাত গড়নের সাক্ষী হয়ে আছে তাঁর দুটি চোখ। এখনো তাঁর কথার মধ্যে আছে রসবোধ। ভাইবোনেরা কে কোথায় আছেন, এই প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘কেউ মরে গেছেন, কেউ সরে গেছেন’। সরে যাওয়ার অর্থ, ভারতে চলে গেছেন। পাঁচ বোনের মধ্যে বেঁচে আছেন শুধু তাঁর বড় বোন রেনুকা ভৌমিক। তিনি মালদহে আছেন। অলোকা ভৌমিকের শেষ ইচ্ছা, ‘আমি যেন হামিদার আগেই মরতে পারি।’
সব শুনে মনে হলো, কবি অলোকা ভৌমিককে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলেন নাটোরের হামিদা বেগম।