ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন ডাকসু নির্বাচনের আলোচনায় সরগরম। প্রার্থীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন, নিজেদের ইশতেহার জানান দিচ্ছেন। অন্যদিকে যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁদের মধ্যেও বেশ রোমাঞ্চ টের পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচিত প্রার্থীদের কাছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়া কী হবে? কেমন নির্বাচন প্রত্যাশা করছেন তাঁরা?

শাহরিয়ার আহমেদ, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনেক বছর পর ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে, এটা আমাদের সবার জন্য আনন্দের ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা শেষ হওয়ায় ক্যাম্পাসে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তবে উৎসবের পাশাপাশি আমি চাই যেন শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ বজায় থাকে।
আমার প্রত্যাশা, নির্বাচন হোক অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক। সবাই যেন ভোট দিতে পারেন এবং নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচন করতে পারেন। কোনো ধরনের অনিয়ম বা প্রভাব খাটানো ছাড়া গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন হলে সেটা হবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সাফল্য।
আমি চাই আমাদের প্রতিনিধিরা সত্যিকারের শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করুক। আমরা চাই না তারা দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিক বা শিক্ষার্থীদের বিভক্ত করুক।
আমার মতে, সবার আগে ক্যাম্পাসের মৌলিক সমস্যা, যেমন শিক্ষার্থীদের আবাসনসংকট, লাইব্রেরি ও গবেষণা–সুবিধার ঘাটতি এবং ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার অভাব—এসব সমাধানে কাজ করা উচিত। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
সিফাত রেজওয়ান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম—বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি মোড়ে ডাকসু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দুঃখজনকভাবে ১৯৯০ সালের পর থেকে এই প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন নির্বাচনবিহীন ছিল। ২০১৯ সালে পুনরায় নির্বাচন হলেও সেটি নানা অনিয়ম ও বিতর্কের কারণে আস্থার সংকটে পড়ে।
এত দিন পর ডাকসু নির্বাচন হওয়ায় ক্যাম্পাস খুবই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। চারদিকে শুধু ডাকসুর আমেজ। নির্বাচনের প্রচারণাও শুরু হয়েছে। হোক কোনো প্যানেলের অথবা স্বতন্ত্র—সব প্রার্থী ভোটারদের কাছে গিয়ে ভোট, দোয়া ও সমর্থন চাইছেন একই তালে। আদর্শিক জায়গা থেকে ছাত্রসংগঠনগুলোর ভিন্নতা থাকলেও এবার সবার হাড্ডাহাড্ডি প্রচারণা আর সহাবস্থান দেখতে ভালোই লাগছে। আশা করি, অভ্যুত্থান–পরবর্তী ডাকসু নির্বাচনে কেউ সহনশীলতা ও ঐক্যের জায়গা থেকে সরে যাবেন না।
আমরা চাই ডাকসু নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হয়ে আসবেন, তাঁরা যেন সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করেন। শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ উন্নত করা; আবাসন, ক্যানটিন, লাইব্রেরি ও চিকিৎসা-সুবিধা বাড়ানো; সব ধরনের সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্র তৈরি করা—এসব ক্ষেত্রে ডাকসু নেতাদের ইতিবাচক ভূমিকা দেখতে চাই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান’ থেকে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা। আমরা চাই না কোনো প্রার্থী ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য দলীয় রাজনীতির অন্ধ অনুশীলন করুক। এমন কোনো ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি না করুক, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আগের সেই ট্রমাতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
রাবিতা ইসলাম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অবস্থা এমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ডাকসু নির্বাচন পাওয়ায় নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতেই হচ্ছে! এখন পর্যন্ত নির্বাচনী পরিবেশ মোটামুটি ভালো। এ অবস্থা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ।
একটা বিষয় চোখে পড়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্যানেলের সদস্য অথবা আগে থেকেই পরিচিত মুখ যাঁরা, তাঁরাই পাদপ্রদীপের আলো পাচ্ছেন। স্বাভাবিক। তবে নতুনদের জন্য সে ক্ষেত্রে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। নতুনদের অনেককেই আমার কাছে যোগ্য মনে হয়েছে।
মানুষ কী দেখে কাউকে ভোট দেয়? নির্বাচনী ইশতেহার দেখে এবং সেটাই হওয়া উচিত, সেটাই যুক্তিযুক্ত। নির্বাচিত হওয়ার পর প্রার্থীরা যেন নিজেদের ইশতেহার ভুলে না যান। ‘জিতেই তো গেছি, এখন আর ওসব মনে রেখে কী হবে’—এমন যেন না হয়। রাজনৈতিক দলের প্যানেল সদস্যরা যেন তাঁদের দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত না হন। কোনো দুর্নীতি বা প্রলোভনে পড়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির স্বভাব পাল্টে যাক, সেটাও চাই না। দলীয় প্যানেলের কেউ নির্বাচিত হলে ওই দলের শিক্ষার্থীদের প্রতি ‘স্বজনপ্রীতি’র মনোভাব সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও ছাত্রীদের অনুপাত প্রায় সমান হওয়ার পরও ছেলেদের ১৩টি আর মেয়েদের ৫টি হল! মেয়েদের হল বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব জমি দখল করা হয়েছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার করা দরকার। ক্যাম্পাসের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে মেয়েদের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।
নওশীন আনজুম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডাকসুর মাধ্যমে আমরা অনেকেই জীবনে প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছি, তাই আমি সত্যিই ভীষণ উৎফুল্ল। ক্যাম্পাসে একধরনের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। প্রার্থীদের নির্বাচনী বিতর্ক, ভোট চাওয়া, ইশতেহার—সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ। এ রকম গণতান্ত্রিক পরিবেশের অপেক্ষা করছিলাম অনেক দিন।
একটা ব্যাপার ভীষণ ভালো লাগছে—এবার প্রচুর স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন, যাঁরা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ করেছেন। দলীয় ব্যানারের বাইরে গিয়েও অনেক জনপ্রিয় মুখ আছেন, যাঁদের আমরা সত্যিকার অর্থেই নেতৃত্বের স্থানে দেখতে চাই। সেই জায়গা থেকে মনে হচ্ছে, এবার কোনো একক প্যানেলের জয় হবে না; বরং বিভিন্ন পদে ভিন্ন ভিন্ন মুখ আসতে পারে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে অনুরোধ থাকবে, শিক্ষার্থীরা যে বিষয়গুলো নিয়ে অনেক দিন ধরে ভুগছে, সেগুলোর সমাধানের ক্ষেত্রে তাঁরা যেন দ্রুত পদক্ষেপ নেন।
ক্যাম্পাসে খাবারের মান ভালো নয়, হলগুলোতে থাকার পরিবেশ ভালো নয়—এ ধরনের নানা সমস্যার সত্যিকার অর্থে যেন সমাধান হয়, সেই চেষ্টা করা দরকার। প্রশাসন ও প্রতিনিধিদের কাছে অনুরোধ থাকবে, প্রতিবছরই যেন এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।