আমার জন্য ও একজন ‘হিউম্যান গুগল’

ক্যাম্পাসে পরিচয়। এরপর বন্ধুত্ব। ধীরে ধীরে একে অপরের শক্তি হয়ে ওঠা, স্নাতক শেষে গাঁটছড়া বাঁধা। শেষমেশ উচ্চশিক্ষা নিতে ভিনদেশের পথেও একসঙ্গে পা বাড়ানো। সহপাঠী থেকে সহযাত্রী হয়ে ওঠা এমনই এক জুটির গল্প শুনুন।

তাবাসসুম মেশিন লার্নিং ও অ্যাডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে, আর ইরতিজা সফট-ম্যাটেরিয়াল সিমুলেশন নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায়।
ছবি: সংগৃহীত

১৬ ডিসেম্বর ২০১৭। বিজয় দিবসের সকাল। লাল-সবুজে ভাসছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাস। এই দিনেই প্রথমবারের মতো সামনাসামনি একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হলেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী রাফাত তাবাসসুম (সুকন্যা) ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সোহাম ইরতিজা (স্বপনীল)।

তাবাসসুম বলছিলেন, ‘আমরা দুজন আগে থেকেই ফেসবুকে যুক্ত ছিলাম, কিন্তু কখনো সরাসরি কথা হয়নি। বিজয় দিবসে প্রথম দেখা। বেশ সংকোচ নিয়েই কথা বলেছিলাম। স্বপনীল ছিল শান্ত, চোখে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। পরে জেনেছি, তার জন্য সেটা ছিল লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।’

একসঙ্গে রাত জেগে পরীক্ষার প্রস্তুতি, নতুন স্কিল শেখা তাঁদের ভালোবাসার সম্পর্ককে আরও গভীর করে।

ইরতিজা স্মৃতিচারণা করেন, ‘বুয়েটে গ্রেড নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকেই। আমরা দুজন আলাদা বিভাগে থাকলেও কখনো কখনো নিজেও অনুধাবন করতাম, আমাদের মধ্যেও একটা নীরব প্রতিযোগিতা কাজ করছে। কিন্তু এটা কখনোই নেতিবাচক কিছু হয়ে ওঠেনি। বরং সেই প্রতিযোগিতার মধ্যেও আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একে অপরকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা। আমরা সব সময় চাইতাম, যেন অপরজন ভালো করে। সেই মানসিকতাই আমাদের সম্পর্কে আস্থা তৈরি করেছে। আজও সেই চিন্তাধারাই বহন করে চলেছি।’

এই বোঝাপড়া কেবল আবেগের জায়গাতেই নয়, একাডেমিক দিকেও স্পষ্ট। তাবাসসুমের গবেষণার অনেকখানি জুড়েই আছে মেশিন লার্নিং, যা ইরতিজার কাছ থেকে শেখা। তাঁর ভাষায়, ‘আমার পিএইচডির ৮০ শতাংশ কাজই মেশিন লার্নিং-ভিত্তিক। আমি কোডিংয়ে খুব একটা দক্ষ ছিলাম না। স্বপনীল ধৈর্য ধরে আমাকে শেখাত। অনেক সময় রাত জেগে প্রজেক্টে গাইড করেছে। আমি সবাইকে বলি—আমার জন্য ও একজন “হিউম্যান গুগল”। জীবনে যখন যেটা দরকার পড়েছে, ওর কাছে তার সমাধান ছিল। ভালোবাসার মানে যদি হয় “সব প্রশ্নের উত্তর”, তাহলে ও আমার উত্তর হয়ে উঠেছে।’

পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁরা একসঙ্গে গবেষণাপত্র লিখেছেন, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য একসঙ্গে আবেদন করেছেন—সেই চেষ্টার ফসল হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্রের দুই নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল-ফান্ডেড পিএইচডি করছেন এই দম্পতি।

ইরতিজা বলেন, ‘দেশে আমরা অনেকের মধ্যেই থাকি। পরিবার, বন্ধু—সবকিছু মিলে আমাদের একটা সাপোর্ট সিস্টেম থাকে। কিন্তু বিদেশে ব্যস্ত জীবনের মধ্যে মনের কথা বলার মতো মানুষ খুব কম পাওয়া যায়। আমরা একে অপরের জন্য সেই সাপোর্ট সিস্টেম। সুকন্যা শুধু আমার সঙ্গী নয়, ও আমার মানসিক শান্তির জায়গা। আমি রান্না পারতাম না, আজও পারি না ভালোভাবে। কিন্তু সুকন্যা প্রতি সপ্তাহে ৫-৬টা পদ রান্না করে। কখনো আমাকে বাসার খাবার মিস করতে দেয় না। এই বিষয়গুলোই আমাদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে, আরও গভীর করেছে।’

এখন তাঁরা দুজনেই গবেষণার দুনিয়ায় আলাদা প্রকল্পে কাজ করছেন। তাবাসসুম মেশিন লার্নিং ও অ্যাডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে, আর ইরতিজা সফট-ম্যাটেরিয়াল সিমুলেশন নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায়। নিজেদের কাজ, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ—সবকিছু নিয়ে আলাদা ভাবনা থাকলেও সম্পর্কের জায়গায় তাঁরা এক। একে অপরকে সম্মান করা, বোঝা এবং ভালোবাসার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এই বন্ধন।