ইরফান লিখেছিল, ‘বৃদ্ধ বয়সে আব্বা–আম্মার কাছে থাকতে চাই’

আজ বন্ধু দিবস। আমাদের দেশে দিবসটি পালিত হয় আগস্টের প্রথম রোববার। বন্ধুত্ব উদ্‌যাপনের জন্যই তো এই দিন। তবে এ বছর পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ, অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে না। এমনকি ক্যাম্পাস যখন খুলবে, তখনো কারও কারও সঙ্গে দেখা হবে না আর। সাম্প্রতিক সহিংসতায় যাঁরা কাছের বন্ধুকে হারিয়েছেন, পড়ুন তাঁদের মধ্যে একজনের লেখা। বন্ধু ইরফান ভূঁইয়াকে নিয়ে লিখেছেন আসিফ রহমান। দুজনই ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন।

ইরফান ভূঁইয়া
ছবি: সংগৃহীত

আমার বন্ধু ইরফান ভূঁইয়া। আমি ডাকতাম ইরফু। এবারের বন্ধু দিবসে ওকে ছাড়া আর কাউকেই এতটা মিস করব না।

দুজনই ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগে পড়েছি। ফেসবুকে ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। ছেলেটা বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের ভীষণ ভক্ত। বিশেষ করে ‘ওয়ারফেজ’। এর বাইরেও অর্থহীন, শিরোনামহীন, ব্ল্যাকসহ আরও অনেক ব্যান্ডের গান খুব শুনত। ওর সঙ্গে আমার ‘টেস্ট’–এর মিল বলেই হয়তো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল দ্রুত।

ক্যাম্পাসে যখন দেখা হলো প্রথমবার, হিসাব করে দেখলাম একই বিভাগের হলেও আমাদের দুজনের সেকশন মেলার কোনো উপায় নেই। কারণ, আমাদের আইডির মাঝখানে ১২৩ জন মানুষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক ছিলেন আনিকা তাসনিম ম্যাম ও ত্বকী ইয়াসির স্যার। লেখালেখি করতে পছন্দ করত। তবে সংকোচে কাউকে দেখাতে চাইত না। একবার দেখিয়েই আবার ডিলিট করে দিত। তবু ফেসবুকে অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি রেখে গেছে ও। প্রোগ্রামিংয়ের জন্য ভিএস কোড ব্যবহার করা শিখেছিল অনেক চেষ্টা করে। বলেছিল, ‘আমাদের ভার্সিটির ছাত্ররা কষ্ট করতে চায় না। ভিএসে কোড করে কী মজা, এরা বুঝবে না।’

অন্যের খুব ভালো অনুকরণ (মিমিক্রি) করতে পারত। আমাদের বেনজির স্যারের নকল করে দেখাত। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল পিয়াল। ওরা একই এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত। পিয়ালের কাছেই শোনা, ইরফানের একটা ভালো মানের কম্পিউটার কেনার ইচ্ছা ছিল। ঠিক করেছিল, ১০০ ভাগ বৃত্তি পেলে কম্পিউটারটা কিনবে। আগেরবার বৃত্তি মিস হয়েছিল, তাই এবার পড়ালেখায় উঠেপড়ে লেগেছিল। শুরুতে অবশ্য সিএসইর প্রতি ওর আগ্রহ ছিল না। চেয়েছিল তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বা যন্ত্রকৌশল পড়বে। কিন্তু বাবার চাপে সিএসইতে ভর্তি হয়। জানিয়ে রাখি, ইরফানের বাবা আমাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের ল্যাব ইনচার্জ। প্রোগ্রামিং কঠিন লাগলেও ইরফান গণিত খুব ভালোবাসত। পরে মেশিন লার্নিংয়ে ওর আগ্রহ জন্মায়।

১৩ মে ফেসবুকে ইরফান লিখেছিল, ‘এই যে বাসায় আসব না বলে বাসায় চলে এলে আম্মা কত খুশি হয়! এই খুশি কেড়ে নিয়ে আমি কীভাবে তোমাদের মতো বিদেশ পাড়ি দিই বলো? বন্ধুদের, বড় ভাইদের “দেশে কিছু করতে পারবি না” কথাকে শুনে আমার একটুও ভয় লাগে না। বৃদ্ধ বয়সে আব্বা–আম্মার কাছে থাকতে চাই। কপালে যা আছে তা–ই হবে, বাপ–মা ছাড়া থেকে হাজার কোটি টাকা কামাইলেও যে শান্তি পাব না আমি...।’

১৮ জুলাই অর্থাৎ ওর মৃত্যুর দিন দুপুরেও ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বিকেলে শান্ত কল করে বলল, ‘ইরফানের গুলি লেগেছে।’ ততক্ষণে আমি জানি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে আমার কাছের দুই বন্ধু হামিম আর সিয়ামের গায়েও রাবার বুলেট লেগেছে। কিন্তু ইরফানের ব্যাপারটা কেন যেন হজম করতে পারছিলাম না। তাড়াহুড়া করে আঙ্কেলের (ইরফানের বাবা) নম্বর জোগাড়ের চেষ্টা করছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে একজন ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করে বলল, ‘ভাইয়া, আমাদের ভার্সিটির একজন মারা গেছে। দেখেন তো চেনেন কি না?’ ফোন হাত থেকে পড়ে যায়। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। তিন-চার দিন আর স্বাভাবিক হতে পারিনি।