
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের দিনরাত সেবা দিয়েছেন শামীমা আক্তার। পরিচিত মহলে তাঁর নাম আশা। আন্দোলন চলাকালে নাম প্রকাশ না করে রুদ্ধশ্বাস সেই অভিজ্ঞতা ‘ছুটির দিনে’র পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেছিলেন তিনি। স্বনামেই এবার লেখাটি ছাপা হওয়ার পরের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই ট্রেইনি চিকিৎসক।
৩ আগস্ট ২০২৪। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সকালেই আমার ডিউটি ছিল। চারপাশে অদ্ভুত এক নীরবতা। সকাল ৯টার দিকে ডক্টরস রুমে গিয়ে দেখি কয়েকজন মিলে প্রথম আলো পড়তে পড়তে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছেন। কাছে গিয়ে দেখি, ‘ছুটির দিনে’তে ছাপা হওয়া ‘এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের ডায়েরি’ পড়ছেন তাঁরা। বুকটা ধক করে উঠল। এই লেখার লেখক যে স্বয়ং আমি! পরিস্থিতি বিবেচনায় লেখার সঙ্গে লেখকের নাম ছাপা হয়নি, শুধু বলা হয়েছে—‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইন্টার্ন চিকিৎসক’!
আমি লিখতে পছন্দ করি। তবে হাসপাতালে স্বচক্ষে দেখা নির্মমতার রক্তাক্ত স্মৃতি বাসায় ফিরে আরেকবার রোমন্থন করার কোনো ইচ্ছা জাগেনি। তবে প্রথম আলো থেকে যখন ঢাকা মেডিকেলের অবস্থা সম্পর্কে লিখতে বলা হলো, তখন কাজটাকে দায়িত্ব বলে মনে হলো। একজন ইন্টার্নের চেয়ে ভালো কেই–বা জানাতে পারে হাসপাতালে আসা মানুষের করুণ অবস্থা। চিকিৎসা নিতে আসা গুলিবিদ্ধ মানুষের আর্তনাদ ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের আহাজারিতে কেটে যাচ্ছে নির্ঘুম রাত। সেসব রাতের কথা লিখে মনে হলো, মন কিছুটা শান্ত হয়েছে।
ডক্টরস রুমের মতো হাসপাতালের অনেক জায়গায়ই সেদিন লেখাটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। কেউ প্রশংসা করছিলেন, কেউবা তাচ্ছিল্যের সুরে মন্তব্য করছিলেন। আমি কারও কথাই শুনছি না, এমন ভাব করে পাশ থেকে চুপচাপ শুনছি। শেষ কবে এভাবে মুখ লুকিয়ে থেকেছি, মনে পড়ে না। এক বড় ভাই তো হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ‘এই তুই না ইন্টার্ন? তোদের ব্যাচে কে লিখেছে এটা?’
যে মানুষটা লিখেছে তার আপাদমস্তক আমার জানা, তবুও অকপটে বলে দিলাম, ‘জানি না।’
ফেসবুকে প্রথম আলোর পেজে ঢুকে দেখি, হাজার হাজার মানুষ লেখাটা পড়েছেন। মন্তব্য করেছেন শত মানুষ। কেউ কেউ লিখেছেন, ‘পড়ে তাদের চোখে পানি এসে গিয়েছে।’
রিপ্লাই দিতে ইচ্ছা করল, আমরা নীরবে কত কেঁদেছি, তার সামান্য অংশই তো লিখেছি মাত্র। রাতের বেলা আহত ব্যক্তিদের রক্ত গায়ে মেখে হলে ফেরার দুর্ভাগ্য তো আর আপনাদের হয়নি। কী দরকার ছিল এত রক্ত ঝরানোর? এখনো কেন দেশটা শান্ত হলো না?
পরিচিত অনেকেই লেখাটা শেয়ার করেছে। অন্য সময় হলে হয়তো গর্ব করে সত্যটা বলতাম। এখন বরং আড়াল করতে হলো। আমরা যাঁরা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি, তাঁদের দেখে নেওয়ার হুমকি ছিল। তাই আর সত্য বলার সুযোগ কোথায়?
সব বাধা সত্ত্বেও একজন ডাক্তার বলেই হয়তো আহত ব্যক্তিদের পাশে থাকতে পেরেছি। নিহত ব্যক্তিদের শেষবারের মতো চোখ দুটি বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। ইতিহাসের একজন সাক্ষী হতে পেরেছি।
সেদিন ডিউটি শেষে হলে ফিরে এলাম। হলের ক্যানটিনে চা খেতে বসেও বেরিয়ে আসতে হলো। কারণ, পাশের টেবিলে একজন অনলাইনে আমার লেখাটা পড়ছেন। আবার না কোন প্রশ্নের মুখে পড়ি, কত আর মিথ্যা বলা যায়!
৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, কী হবে কে জানে। হাসপাতালে আমরা আবারও শত শত রোগী সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। এক ফাঁকে ফেসবুকে ঢুকে দেখি, মিছিলের ছবি আর ভিডিওতে ভরে গেছে টাইমলাইন। শোনা গেল, ‘শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন।’ অবিশ্বাস্য মনে করে কাজে মনোযোগ দিলাম।
রোগীর ছাড়পত্র লিখছি। টানা কাজ করে শরীরে আর শক্তি নেই। আশপাশের সবার মুখে একই আলোচনা। ওদিকে নাকি গণভবন ভেঙে মানুষ ঢুকে পড়েছে। বিশ্বাস হচ্ছিল না। এক সহকর্মী তাঁর ফোনে ভিডিও দেখালেন। দুইবার দেখলাম ভিডিওটা। আসলেই তাহলে সত্য? গুজব নয়?
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে মিছিলের শব্দ। সকালে চানখাঁরপুলের দিকে গোলাগুলির শব্দ শোনার কিছুক্ষণ পর মৃতদেহ এসেছিল। এবারের শব্দ শুনেও মনে মনে রেডি হতে থাকলাম। কিন্তু এবারের মিছিলের আওয়াজটা কেমন যেন অন্য রকম শোনাল। মনে হলো, সবাই আনন্দমিছিলে বেরিয়েছে।
রুমমেটের কল এল। জানতে পেলাম, সত্যিই দেশত্যাগ করেছেন শেখ হাসিনা। কেন যেন আমার মধ্যে কোনো আনন্দ কাজ করল না। এত রক্ত দেখা মানুষ কি আর খুশি হতে পারে?
বাইরে মিছিলের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগল। ব্যাচমেটরা আনন্দমিছিলে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। যেতে যেতে সবাই নিজেদের চাপা কষ্টের কথা বলছিল। আমি কী বলব, জানতাম না। শুধু মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘এতগুলো মৃতদেহ আজ অর্থ খুঁজে পেল।’
আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হলাম। একেকজন একেক অভিজ্ঞতার কথা বলছিল। আমিও আমার চাপা সত্যটা ফাঁস করে দিলাম। আমার আশপাশে থাকা বন্ধুরা হেসে বলল, ‘আমরা জানতাম, এটা তুই ছাড়া আর কেউ না।’
জেনেও তাহলে তারা কেন চুপ ছিল? কারণ, সেটা ছিল সবার চুপ থাকার সময়।
আরেক বন্ধু হেসে বলল, ‘যাক, আমাদের সুবোধ জেগে উঠেছে।’