কানের লাল গালিচায় হাঁটবেন আজিম

এবার কান চলচ্চিত্র উৎসব চলাকালে ব্রিটিশ সাময়িকী ইনটিগ্রিটির ফ্যাশন অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের ফ্যাশন শোতে হাঁটবেন বাংলাদেশের মডেল আজিম। এই পত্রিকার আগস্ট সংখ্যার প্রচ্ছদেও দেখা যাবে তাঁকে।

আজিম
ছবি: গ্রেস মুন

সরদার আজিমউদ্দৌলাকে পাঠানো কান উৎসব কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণপত্রটি আমার কাছে আসে গতকাল দুপুরে। কোরিয়ান-আমেরিকান ফ্যাশন ডিজাইনার গ্রেস মুন আমাকে পাঠান। খবরটি অভিভূত করার মতো। তবে হ্যাঁ, সরদার আজিমউদ্দৌলা বললে অনেকের না চেনারই কথা। বরং আজিম বলাই ভালো। কারণ ফ্যাশন জগতে এই জনপ্রিয় মডেল আজিম নামেই সুপরিচিত।

আজিম

ফোন করি আজিমকে। তাঁর উচ্ছ্বাস জানার চেষ্টা করি। কারণ, তাঁর হাতে ওই চিঠি পৌঁছেছে দিন দুয়েক আগে। কানের লালগালিচায় তিনি হাঁটবেন আজিম। এটা তো স্বপ্নের মতোই কোনো সন্দেহ নেই। অন্তত সেই অনুরণন শোনা গেল তাঁর কণ্ঠেই। বললেন, ‘মডেলিং করছি অনেক বছর। দেশে–বিদেশে কাজও করেছি। তবে এ ধরনের আন্তর্জাতিক আসরে নিজেকে উপস্থাপন করার স্বপ্ন তো থাকেই। সেটা সত্যিই হতে যাচ্ছে। আমি সত্যিই ভাগ্যবান। কারণ, এই সুযোগ সবাই পায় না। আমি পেয়েছি।’
র‌্যাম্পে হাঁটা থেকে পণ্যদূত কিংবা বিজ্ঞাপন চিত্র—মোটামুটি বিচরণ সর্বত্র, সুনামের সঙ্গেই। এর সঙ্গে তাঁর মুকুটে যোগ হতে যাচ্ছে সাফল্যের নতুন পালক। কান চলচ্চিত্র উৎসবের মতো বৈশ্বিক আসরে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের।

গ্রেস মুনের সঙ্গে পরিচয় এ বছরের গোড়ায়। ঢাকা এসেছিলেন আজিমেরই ব্র্যান্ড লঞ্চ করতে। এরপর থেকে যোগাযোগ আছে নিয়মিত। হোয়াটসঅ্যাপে গতকাল সকালেই জানালেন যে এ বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে যাচ্ছেন। তিন দিনের একটি ইভেন্টে তিনি ডিজাইনার হিসেবে আমন্ত্রিত। ব্রিটিশ ফ্যাশন ম্যাগাজিন ইন্টিগ্রিটির ফ্যাশন অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে তাঁর ফ্যাশন কালেকশন প্রদর্শন করবেন।

গ্রেস মুন

এরই কিছুক্ষণ পর জানালেন রেড কার্পেট অনুষ্ঠানে তাঁর ডিজাইন করা পোশাক পরে হাঁটবেন বাংলাদেশর মডেল আজিম। সঙ্গে পাঠালেন আজিমকে পাঠানো কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণপত্র।

কান চলচ্চিত্র উৎসবে আমাদের চলচ্চিত্র তারকারা গেছেন। পরিচালকেরাও। তবে এমন রেড কার্পেটে ক্যাটওয়াক এর আগে কোনো মডেল করেনি বা করার সুযোগ পাননি। এবার সেটাই করতে চলেছেন আজিম। তাঁর এই কৃতিত্ব বাংলাদেশের জন্য গর্বের।

কেবল তা–ই নয়, এই ইভেন্টে গ্রেস মুন নিজের প্রসাধনসামগ্রীর নতুন লাইনও আনুষ্ঠানিকভাবে লঞ্চ করবেন। সেখানে পুরুষদের প্রসাধনীর ভুবনদূত হবেন আজিম। যাকে বলে সোনায় সোহাগা।

গ্রেস মুনের প্রসাধনী

কান চলচ্চিত্র উৎসবে নানা ধরনের ইভেন্ট হয়ে থাকে ছায়াছবি প্রদর্শনের পাশাপাশি। এরই অংশ হিসেবে ইন্টিগ্রিটি সাময়িকী আয়োজন করছে তাদের ফ্যাশন অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান। সেখানেই নিজের নতুন কালেকশন উপস্থাপন করবেন গ্রেস মুন। হোয়াটসঅ্যাপে টুকরা আলাপচারিতায় জানালেন, অতিমারিই তাঁর বিষয়। গৃহবন্দী মানুষকে মাথায় রেখেই তিনি বানিয়েছেন লাউঞ্জওয়্যার। কিছু ছবিও দিয়েছেন। তবে মূল সংগ্রহের সবটাই এখনো শেষ করে উঠতে পারেননি।

ইন্টিগ্রিটি ম্যাগাজিনের আগস্ট সংখ্যার প্রচ্ছদে মডেল হচ্ছেন আজিম

এখন পর্যন্ত যা কথা হয়েছে, তাতে আজিম জানালেন, ইন্টিগ্রিটি ম্যাগাজিনের আগস্ট সংখ্যার প্রচ্ছদে তিনি মডেল হচ্ছেন। সে শুটও হবে ওই সময়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১১ জুলাই তিনি ঢাকা ছাড়বেন।

২০১০ সালে মডেলিং শুরু করেন আজিম। দেখতে দেখতে পার করেছেন এক দশকের বেশি সময়। এর মধ্যে প্রচুর কাজ করেছেন। উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে আছে রাজস্থান হেরিটেজ উইকের ফ্যাশন শোতে অংশ নেওয়া। ২০১৭ সালের এই ইভেন্টে তিনি ভারতের বিখ্যাত সব ডিজাইনারের পোশাক পরে ক্যাটওয়াক করেন। নানা সময়ে কাজ করেছেন বিবি রাসেলের সঙ্গে। বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক, আড়ংয়ের শো, জুরহেমের শোসহ শীর্ষস্থানীয় সব ইভেন্টে অংশ নিয়েছেন।

ক্যাটওয়াকে আজিম

মডেলিং করেছেন লন্ডনে, ভারতে। ভারতের বিখ্যাত ফ্যাশন কোরিওগ্রাফার প্রসাদ বিদাপ্পার সঙ্গেও রয়েছে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা। ক্যাটস আইয়ের পণ্যদূত ছিলেন ২০১৩ থেকে চার বছর। পরেও কাজ করেছেন। মডেল হয়েছেন বিভিন্ন ফ্যাশন ও অন্যান্য ব্র্যান্ডের। ক্লিয়ার শ্যাম্পু, বিক, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, বাংলালিংক, রবিসহ তালিকা আরও দীর্ঘ।

এই তালিকায় এ কাজ হবে উজ্জ্বলতম অর্জন। এর মধ্য দিয়ে বিস্তৃত হবে আজিমের কাজের পরিধি, ছড়াবে তাঁর নাম। বাংলাদেশও একই সঙ্গে এই জগতে পরিচিত পাবেন।

গ্রেস মুন যা বললেন

২০১৯ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর উপস্থাপনা শেষে মডেলদের সঙ্গে মুন (বাঁ থেকে প্রথম)

এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ এবং আজিমকে তাঁর প্রসাধনীর গ্লোবাল মেল মডেল করার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম গ্রেস মুনের কাছে। উত্তরে তিনি জানিয়েছেন পুরো বিষয়টা।

গেলবারের সঙ্গে এবারের পার্থক্য

‘২০১৯ সালে আমি প্রথম কান চলচ্চিত্র উৎসবে যাই। সেবার আমেরিকান গ্লোবাল শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অংশ হিসেবেই আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আর এবার যাচ্ছি ব্রিটিশ ফ্যাশন ম্যাগাজিন ইনটিগ্রিটির আমন্ত্রণে। তাদের তিন দিনের বিশেষ ইভেন্টে আমি অতিথি। তবে দুটোর মধ্যে তফাৎ হচ্ছে আয়োজক বা আমন্ত্রণকারী। আগেরবার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর এবার যুক্তরাজ্য।’

এবারের সংগ্রহের বিশেষত্ব

এবারের কনসেপ্ট হলো বিবিধের মাঝে মিলন

‘আমার সংগ্রহেও থাকবে বিশেষত্ব। কারণ, এই আসর কোনো ফ্যাশন উইক নয়। বরং চলচ্চিত্র উৎসব। তাই আমি যে সংগ্রহ উপস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেটা হবে শৈল্পিক, বর্ণময়, তবে আধুনিক অথচ ঐতিহ্যসম্মত কোরিয়ান পোশাক। আমার শোর শিরোনাম হবে: ডাইভারসিটি অ্যান্ড ইউনিটি। কারণ, এই চলচ্চিত্র উৎসব সত্যিকার অর্থেই বৈশ্বিক। বিশ্বের নানা ভাষার ছবি এখানে প্রদর্শিত হয়। সেসব ছবির গল্পে থাকে নানা ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর কৃষ্টি। এটাও তো একধরনের বিনিময়। আমিও আমার সংগ্রহে সেটাই দেখাতে চেয়েছি।’

নিজের সংগ্রহের পোশাকে গ্রেস ফুটিয়ে তুলবেন কোরিয়ান ঐতিহ্য। তবে সেই পোশাক হবে আধুনিক এবং ট্রেন্ডি। বৈচিত্র্যময় সব রঙের উপস্থিতিই পোশাককে নান্দনিক করবে। আর এর মধ্য দিয়েই তিনি সবাইকে নিয়ে উদ্‌যাপন করতে চান বিবিধের মধ্যে মিলনের সৌন্দর্য।

আজিমকে বেছে নেয়ার কারণ

‘অন্যান্য কাজ দিয়েই তাঁকে আমি জেনেছি। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ও কাজের মধ্য দিয়ে। আমার মনে হয়েছে আজিমের শারীরিক গঠন এবং লুক আন্তর্জাতিক মঞ্চের জন্য উপযুক্ত। একই সঙ্গে অভিজ্ঞতা অর্জনও গুরুত্বপূর্ণ। আমার আরও মনে হয়েছে, ভালো কাজ করার ইচ্ছা তাঁর আছে। নিজেকে তিনি সেভাবে প্রস্তুতও করেছেন, যাতে আন্তর্জাতিক স্তরে কাজ করতে পারেন।’

ঢাকায় মুনের সঙ্গে আজিম

আজিমের যে বিষয়টি ডিজাইনার হিসাবে তাঁকে আকর্ষণ করে

‘বিশ্বজুড়ে মডেল হওয়ার মতো ছেলেমেয়ের কিন্তু অভাব নেই। তবে তাঁদের মধ্যে সত্যিকারের বিশেষত্ব আমি খুঁজে পাই না, যেটা দিয়ে তাঁরা দর্শককে আকর্ষণ করতে পারবেন। আর ডিজাইনার হিসেবে আমি তাঁদেরই খুঁজি, যাঁরা আমার ডিজাইনকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন। এ জন্য মডেলরা আমার কাছে আমার সন্তানের মতো। আমি ঠিক সেভাবেই তাঁদের দেখি। আমার মনে হয়েছে আজিমের মধ্যে আমি সেই বিশেষত্ব আর আত্মবিশ্বাস দেখেছি যা যেকোনো ডিজাইনারের সৃষ্টিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম।’