
‘ঊষর মরুর ধূসর বুকে বিশাল যদি শহর গড়ো তার চাইতে একটি জীবন সফল করা অনেক বড়।’
ঠিকমতো পড়তে শেখার আগেই এই পঙ্ক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। এই পঙ্ক্তি কিন্তু বইয়ের পাতায় পড়িনি। বরং দেখেছিলাম গ্রামের বাড়ির দেয়ালে ঝোলানো দাদির হাতের বাঁধাই করা সুচিকর্মে। সুচিশিল্পী নিজেও কি জানতেন কবির নাম-পরিচয়!
আমাদের গ্রামগুলোতে এমন সুচিকর্ম অনেক বাড়িতেই পাওয়া যাবে। আলমারি বা ট্রাঙ্কে তোলা পাবেন নকশিকাঁথা। ‘কত দুঃখ, কত হাসি, কত আনন্দ, কত কোলাহল, কত কলহ, মান অভিমানের স্বাক্ষর এই কাঁথাগুলো তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।’ চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান লিখেছেন লোকশিল্পের মর্মকথা প্রবন্ধে। ‘ঊষর মরুর ধূসর বুকে বিশাল যদি শহর গড়ো তার চাইতে একটি জীবন সফল করা অনেক বড়।’
ঠিকমতো পড়তে শেখার আগেই এই পঙ্ক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। এই পঙ্ক্তি কিন্তু বইয়ের পাতায় পড়িনি। বরং দেখেছিলাম গ্রামের বাড়ির দেয়ালে ঝোলানো দাদির হাতের বাঁধাই করা সুচিকর্মে। সুচিশিল্পী নিজেও কি জানতেন কবির নাম-পরিচয়!
আমাদের গ্রামগুলোতে এমন সুচিকর্ম অনেক বাড়িতেই পাওয়া যাবে। আলমারি বা ট্রাঙ্কে তোলা পাবেন নকশিকাঁথা। ‘কত দুঃখ, কত হাসি, কত আনন্দ, কত কোলাহল, কত কলহ, মান অভিমানের স্বাক্ষর এই কাঁথাগুলো তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।’ চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান লিখেছেন লোকশিল্পের মর্মকথা প্রবন্ধে। জামদানি, মসলিন বা রেশমের মতোই ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশের সুচিশিল্প। গ্রামীণ নারীর উঠান থেকে প্রসার পেয়ে বড় বড় ফ্যাশন হাউসের প্রদর্শনীতে জায়গা করে নিয়েছে। বরফি পাড় আর একটু ঘন করে বোনা হলে হয়ে যায় কাঁটা বরফি। চোখ–পাড়েই আছে অন্তত দশ রকম বৈচিত্র্য। থানকুনি পাতা, কলমিলতা, মোচা ফুল, শজনে—সবই উঠে আসে সুচের ফোঁড়ে কাপড়ের পটভূমিতে। এক অঞ্চলের খেজুরকাঁটাই আরেক অঞ্চলে হয়ে যায় মাছের কাঁটা। সেই ফোঁড়ই আবার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হেরিংবোন নামে। এতসব তথ্য হয়তো জানা নেই ক্রেতাদের। তবু তাঁদের কাছে হাতের কাজের পোশাকের আকর্ষণ অনেক। দাম বেড়েছে, আগের মতো পেটানো কাজের বাহারও কম, কিংবা সে রকম নকশা করা পোশাক পাওয়া গেলেও তা সাধারণ মধ্যবিত্ত ক্রেতার নাগালের বাইরেই থাকে। এসব কিছু মেনে নিয়েও বাংলাদেশের ক্রেতারা টিকিয়ে রেখেছেন হাতের কাজের চাহিদা। ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরাও তা-ই আশাবাদ দিলেন, অন্য অনেক কিছুর মতো এ ঐতিহ্য সহসা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। বরং এতে যোগ হচ্ছে আরও বৈচিত্র্য।
এ বছরের জুনে ঢাকায় হয়েছে ‘সিম্ফনি অব নিডলওয়ার্ক’ নামে একটি প্রদর্শনী। ফ্যাশন হাউস বিবিয়ানার আয়োজনে এ প্রদর্শনী ঘিরে মানুষের আগ্রহ যেন জানান দিল, পোশাকের নকশায় মেশিন এমব্রয়ডারি বা নানা রকম প্রিন্ট যতই জেঁকে বসুক, হাতের কাজের আবেদন থাকবে সব সময়। আয়োজক লিপি খন্দকারের সঙ্গে কথা হলো। হাতের কাজের নকশা করা পোশাক উচ্চমূল্যের হবে, এটা জেনেও ক্রেতারা চেষ্টা করেছেন সাধ্যের মধ্যেই কিছু একটা সংগ্রহ করার।
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আড়ং তাদের পণ্যসম্ভারে রেখেছে হাতের কাজের প্রাধান্য। চন্দ্রশেখর সাহা, মাহিন খান প্রমুখ ডিজাইনারের প্রচেষ্টায় আড়ংয়ের হাতের কাজ করা সালোয়ার-কামিজ হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয়। সেই ধারা থেকে সরে আসেনি তারা। বরং এই সময়ে তাতে যোগ করা হচ্ছে আরও বৈচিত্র্য। নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে দামটা ক্রেতার নাগালে রাখার। যেমন পুরো পোশাকে কাজ না করে হয়তো হাতায় একটু কাজ রাখা হলো। তাতে তৈরির খরচটাও কমে এল। জানালেন আড়ংয়ের জ্যেষ্ঠ ডিজাইনারশাহীনা রাব্বি।
লিপি খন্দকার ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন আড়ং থেকেই। পরে গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠান বিবিয়ানা। শুরু থেকে তাদের সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, পাঞ্জাবি সব ধরনের পোশাকে ছিল সুতার নকশার প্রাধান্য। ‘আমাকে ইদানীং অনেকেই বলছিলেন বিবিয়ানায় সেই আগের মতো পোশাকগুলো পাই না কেন। আমার নিজেরও মনে হচ্ছিল, সবকিছু একটু গুছিয়ে নিয়ে সুই-সুতার ফোঁড়ে মনোযোগ দিই। আমাদের প্রোডাক্ট লাইনে নতুনভাবে আনা হয়েছে সেই ধরনের পোশাক। প্রদর্শনীর পর থেকে ক্রেতাদের সাড়াও পাচ্ছি খুব। এই ধারাতেই সামনে আরও নতুন সংগ্রহ আনা হবে,’ বললেন তিনি।
ভারতবর্ষের বয়নশিল্পে সুচিশিল্পের ব্যবহার প্রচুর। গুজরাটের সুতার কাজ, রাজস্থানের আরির কাজ, লক্ষ্ণৌয়ের চিকন কাজ, চম্বার রুমালের কাজ, পাঞ্জাবের ফুলকারি, বাংলার কাঁথাশিল্প—সবই এ অঞ্চলের সুচিশিল্পের সমৃদ্ধতার কথা তুলে ধরে। (সূত্র: বাংলার নকশিকাঁথা, শীলা বসাক)
‘কাঁথা সেলাইয়ের ফোঁড়গুলোই এখন নানাভাবে উঠে আসছে পোশাকে’ জানালেন লিপি খন্দকার। একই পোশাকে নানা রকম ফোঁড়ের মিশ্রণেও তৈরি হচ্ছে নতুন নকশা। যেমন শাড়ির পুরো জমিনজুড়ে ডাল ফোঁড়ের নকশা করে তার সঙ্গে একটু যোগ করা হলো ক্রস ফোঁড়, মাছকাঁটা কিংবা গিঁট ফোঁড়। আবার শাড়ির আঁচলে সুজনি ভরাট করে তার চারপাশে বর্ডার টেনে দেওয়া হলো ডাল ফোঁড় দিয়ে। কাশ্মীরি ভরাট, বোতাম ফোঁড়, খেজুরকাঁটার মিশ্রণে তৈরি হলো ফ্যাশনেবল লং জ্যাকেট। সাদা মসলিন শাড়ির পাড়ে সাদা কাপড়েই সূক্ষ্ম অ্যাপ্লিকের কাজে করে আনা হলো দারুণ আভিজাত্য।
আড়ং, মায়াসীর, অরণ্য, বিবিয়ানা ইত্যাদি ফ্যাশন হাউস ঘুরে দেখা গেল, হাতের কাজের নকশায় রঙের বাহারটা খুব ফুটে উঠছে এমন নয়। কাপড়ের সঙ্গে সুতার রঙের বৈপরীত্যও তেমন নেই। চড়া রং বা কন্ট্রাস্টে হয়তো মনোযোগ কেড়ে নেবে সুতার সূক্ষ্ম কাজের ওপর থেকে। এমন ভাবনা থেকেই ডিজাইনাররা সম্ভবত এড়িয়ে চলছেন চড়া রঙের ব্যবহার। তাতে বরং আরও প্রাধান্য পাচ্ছে সুতার কাজটাই।
শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ তো আছেই। ছেলেদের পাঞ্জাবিতেও হাতের কাজের কদর বেশ। জানালেন ড্রেসিডেলের ডিজাইনার মায়া রহমান। ‘মেশিন এমব্রয়ডারি কিংবা জারদৌসির ঝকমকে ভাবটা অনেক ছেলে পছন্দ করেন না। তাঁরা বেছে নেন সুতার কাজের নকশা করা পাঞ্জাবি,’ বললেন তিনি। এই শীতে তসর ও ক্রেপ কাপড়ে সুতার নকশা বেশ দেখা যাবে বলেও জানালেন।
দেশজুড়েই হাতের কাজের চর্চা মোটামুটি থাকলেও কিছু অঞ্চল বিখ্যাত বিশেষ কাজের জন্য। যেমন আড়ং অ্যাপ্লিকের কাজ করায় পাবনার শিল্পীদের দিয়ে। কাঁথা ফোঁড় ভালো হয় শেরপুর, জামালপুর, যশোর, কুষ্টিয়ায়—জানা গেল তাদের ডিজাইনার শাহীনা রাব্বির কাছ থেকে।
‘বাংলাদেশে বড় ফ্যাশন হাউসগুলোর পাশাপাশি ছোট উদ্যোক্তারাও চেষ্টা করছেন হাতের কাজের সংগ্রহ নিয়ে আসার। এর প্রসার বেশ ভালোভাবেই চলছে,’ বললেন ফ্যাশন ডিজাইনার শাহিদ হোসেন, বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের বোর্ড সদস্য হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
আগামী বছর থেকে নাম, নকশা, অঞ্চল ইত্যাদি ধরে ফোঁড়গুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে পরিষদ থেকে, জানালেন তিনি। ‘তবে জাদুঘরে বন্দী করে নয়, কারুশিল্পীদের এই কাজ চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে চাই আমরা,’ তিনি বলেন।