পরিবেশবান্ধব খেশ শাড়ি কি এভাবেই হারিয়ে যাবে

রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার পদ্ধতিতে তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী এই শাড়ি। মডেল: মানসী সাহা, শাড়ি: তাঁতি, স্থান কৃতজ্ঞতা: যাত্রা বিরতি
ছবি: কবির হোসেন

টাঙ্গাইলে তাঁতের শাড়ি ছাড়াও তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী আরও একটি শাড়ি। এ শাড়ি অনেকে দেখেছেন, পরেছেনও; কিন্তু নামটা হয়তো জানেন না। বলছি, খেশ শাড়ির কথা। রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় ঐতিহ্যবাহী এই শাড়ি।

ফ্যাশন ডিজাইনার আফসানা ফেরদৌসী জানান, সৌন্দর্য ও কৌশলের মাধ্যমে পুরোনো কাপড় কীভাবে নতুন রূপে ফিরে আসতে পারে, আমাদের তা–ই শেখায় খেশ শাড়ি। এই ঐতিহ্য আমার কাছে টেকসই ফ্যাশনের ভবিষ্যৎ পথপ্রদর্শক। এটি কেবল পরিবেশবান্ধব নয়; বরং স্থানীয় কারিগরদের দক্ষতা ও সংস্কৃতির পরিবাহক।

খেশ শাড়ি পরিবেশবান্ধবও বটে

এ শাড়ির উৎপত্তি কিন্তু কলকাতায়, ১৯২০ সালে। পুরোনো শাড়ি আর ধুতি পুনর্ব্যবহার করে নতুন শাড়ি তৈরি করতে চেয়েছিলেন সেখানকার তাঁতিরা। পুনর্ব্যবহারের এ ধারণা থেকেই তৈরি হয় খেশ শাড়ি। তাদের খেশ তৈরির হাতেখড়ি হয়েছিল শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিল্প সদনে। সেখানকার শিল্পীরা কাঁথা সেলাইয়ের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে পুরোনো কাপড় দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে খেশ শাড়ি তৈরি করে দেন।

এখন বাজারে খেশ শাড়ি তেমন একটা পাওয়া যায় না। এই শাড়ি নিয়ে কাজ করা ফরচুন শপিং মলের তাঁতি দোকানের স্বত্বাধিকারী মানস সাহা জানান, এর মূল কারণ হলো তাঁত এবং তাঁতির সংকট। খেশ শাড়ি মূলত করা হয় চিত্তরঞ্জন তাঁতে, যে জন্য দীর্ঘদিন ধরে যে তাঁতিরা কাজ করেন, তাঁরাই শুধু খেশ শাড়ি তৈরি করতে পারেন। এ ছাড়া এখন চিত্তরঞ্জন বা জাপানি তাঁতের সংকট চলছে, ফলে এই পেশা থেকে অনেক তাঁতিই সরে যাচ্ছেন।

খেশ শাড়ি বানানো হয় চিত্তরঞ্জন তাঁতে

বর্তমানে সবাই পাওয়ারলুমে বিনিয়োগ করতে চান, চিত্তরঞ্জনে একেবারেই বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। এর মধ্যেও ছয়জন আদি তাঁতি নিয়ে খেশ শাড়ি তৈরি করছেন পূর্ণতা শিল্পশালার স্বত্বাধিকারী সুলতানা জান্নাত। বংশগতভাবে নিজেদের নকশায় তাঁতের কাজ করে আসছেন এই তাঁতিরা। মানস সাহাও বংশপরম্পরায় তাঁতিদের নিয়ে কাজ করে আসছেন। মানস সাহার তৈরি সর্বশেষ খেশ শাড়ির বুননে ছিল সুতি আর খাদি কাপড়। একটু মোটা ফ্রিল বা খাদি কাপড় দিয়েই করা হয়েছিল শাড়িগুলো। শাড়িগুলোতে কোনো নকশা ছিল না। কিছু মিশ্র সুতা বা উলের সুতা মুড়িয়ে করা হয়েছে।

সুলতানা জান্নাতের কাছে জানা গেল, এই শাড়ি তৈরির পদ্ধতি, পুরোনো কাপড় বেশ কয়েকবার ধুয়ে চিকন দড়ির মতো খেশ বানাতে হয়, যে কারণে শাড়িটির নাম করা হয়েছে খেশ। এই দড়িই খেশ শাড়ির বৈশিষ্ট্য। এই খেশ বানাতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ দিন। এই খেশ আর সুতি সুতা দিয়ে হাতের তাঁতে শাড়ি বুনতে একজন তাঁতির সময় লাগে দুই থেকে তিন দিন। খেশ শাড়ি ৬০ কাউন্টের মাড় ছাড়া সুতা দিয়ে তৈরি করা হয়। বুননের সময় সুতায় মাড় না দেওয়াটা খেশ শাড়ির আরেকটি বৈশিষ্ট্য। তাই এই শাড়িগুলো নরম তুলতুলে হয়ে থাকে, পরতেও বেশ আরাম।

খেশ শাড়ি মাঝেমধ্যে রোদে দিলে অনেক দিন পর্যন্ত ভালো থাকবে

সেফটিপিন ছাড়াও অনায়াসেই পরা যায় খেশ শাড়ি। মাড় না থাকায় ব্লকপ্রিন্ট বা টাই-ডাই করলে এই শাড়িগুলোতে রং স্থায়ী হয়। ভিন্নতা আনার জন্য শাড়িতে সুই সুতা বা কাঠ ব্লকের কাজও করে থাকেন সুলতানা জান্নাত। কিছু শাড়িতে আবার উন্নত মানের সিল্ক ও সুতি সুতাও মেশান। তিনি জানান, খেশ শাড়ির সঙ্গে গ্রামীণ চেক, টাইডাই, প্রিন্ট,, সুতি, খাদি বা তাঁতের ব্লাউজ পরলে বেশ ভালো মানায়।

খেশ শাড়ির যত্ন

  • বাড়তি যত্নের প্রয়োজন নেই। যেকোনো ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুলেই যথেষ্ট।

  • ধোয়ার পর হালকা মাড় ব্যবহার করাই ভালো।

  • মাঝেমধ্যে রোদে দিলে অনেক দিন পর্যন্ত ভালো থাকবে।

তথ্যসূত্র: পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ