
একটা ফ্যাশন শো, যেখানে নানা পোশাক আর অনুষঙ্গ ধারণ করে হেঁটে চলেছেন মডেলরা। আলোঝলমল পরিবেশ, তাক করা ক্যামেরার সারি, দর্শকের উচ্ছ্বাস, করতালি...। এ–ই কি শেষ? ডিজাইনার তাঁর সৃষ্টিশীলতা কি কেবলই এই একটি শোর জন্যই করেছেন? তা তো নয়। কখনো ফ্যাশন শো আগামী দিনের বার্তা দেয়, কখনো মনে করিয়ে দেয় ঐতিহ্যের কথা, কখনোবা চোখ ধাঁধায় প্রযুক্তির ব্যবহারে। তেমনই ফ্যাশন শো দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল কিছুদিন আগে।
মস্কো ফ্যাশন উইক ২০২৫-এর আসর বসেছিল রাশিয়ার মস্কোর জারইয়াদিয়া পার্কে। ২৮ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর ৬ দিনের এই আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শোয়ে রাশিয়ার মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ, কাজান, ইয়াকুতস্ক থেকে শুরু করে আর্মেনিয়া, নিকারাগুয়া, ব্রাজিল, চীন ও ভারতের ডিজাইনাররা মিলে যেন এক নতুন বিশ্বভাষা তৈরি করলেন, যার নাম ফ্যাশন।
ছয় দিনের এই ফ্যাশন মিলনমেলায় শহরটি রূপ নিয়েছিল নন্দননগরীতে। পার্কিং গ্যালারির আর্ট স্পেস, ভাসমান সেতুর ওপর স্বচ্ছ আকাশ, ঐতিহাসিক কিতাইগারোদস্কাম, পুশকিন স্টেট মিউজিয়াম, লিও তলস্তয় স্টেট মিউজিয়াম, বলোতনাইয়া স্কয়ার—এসব স্থান ফ্যাশনের ছন্দে হয়ে উঠেছিল একেকটি কবিতা।
যেখানে ঐতিহ্য, প্রযুক্তি ও সৃষ্টিশীলতা মিলেমিশে তৈরি করেছে পোশাকের নতুন নকশা আর ভাবনা। একই সঙ্গে ২৮ থেকে ৩০ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্রিকস+ ফ্যাশন সামিট। যেখানে বিশ্বের উদ্ভাবনী ডিজাইনার, উদ্যোক্তা ও নীতিনির্ধারকেরা মিলিত হয়েছিলেন। আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ভবিষ্যৎ ফ্যাশনের পথরেখা।
এ বছরের ফ্যাশন উইকের একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল ওয়াইল্ডবেরিজ প্রদর্শনী, যেটা রাশিয়ার সমৃদ্ধ আঞ্চলিক ঐতিহ্য উদ্যাপন করে। এই কিউরেটেড প্রদর্শনীতে ছয়জন রুশ ডিজাইনার অংশ নেন, যাঁরা তাঁদের আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পোশাক বানান।
এর বাইরে যে কজন ডিজাইনার প্রশংসা পেয়েছেন মস্কো ফ্যাশন উইকে, তার মধ্যে অন্যতম মান্দ্রাগর এআইয়ের সংগ্রহ। ভাসমান সেতুর ওপর যেন গড়ে উঠেছিল এক মায়াবী বন, যেখানে পাইয়োটা ইলিভ চাইকোভস্কির অসমাপ্ত অপেরা মিশে গিয়েছিল ডিজিটাল জাদুর ছোঁয়ায়।
সেন্ট পিটার্সবার্গের লস্ট জিনোম, মস্কোর ক্যাটিস কিডস, গুয়াতেমালার মারিয়ান্দ্রে গাইটান লস্ট, দ্য নয়ার কোলেকটিভ ফ্যাশনের র্যাম্পে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছরও তাঁদের পোশাকের নকশা অনুসরণ করবেন অনেকেই। পিটার্সবার্গের জিনোম লিলি ফুলের পবিত্রতায় খুঁজেছে শক্তি ও জ্ঞান। যুক্তরাষ্ট্রের পিয়া লিন্ডসে স্টুডিও উপস্থাপন করেছে নারীর আত্মবিশ্বাসের নিখাদ বন্দনা।
মস্কোর সোরোকা অন কোর্স সংগ্রহ উপস্থাপন করেছে পুশকিন স্টেট মিউজিয়ামের ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণে। স্থানটির প্রতীকী অর্থ ছিল গভীর, কস্টিউম ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এই সংগ্রহের পোশাকগুলো অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যতের একটি সংলাপ তুলে ধরেছিল।
পোশাকের প্রতিটি স্তর, প্রতিটি ড্রেপ যেন বলছিল রুশ শিল্প–ঐতিহ্যের নীরব কাব্য। লিও তলস্তয় স্টেট মিউজিয়ামের শান্ত পরিবেশে মস্কোর রুবান ব্র্যান্ড উপস্থাপন করল তাদের স্প্রিং-সামার ২০২৬ সংগ্রহ। তলস্তয়ের দর্শন, প্রকৃতির প্রতি গভীর প্রেম এবং মানবিক সরলতার অনুপ্রেরণায় এই সংগ্রহ ছিল আত্মমগ্ন, অথচ সমসাময়িক। মস্কো ফ্যাশন উইক ২০২৫ প্রমাণ করল, ফ্যাশন এখন কেবল পোশাক নয়, এখানে ঐতিহ্য মিশে যায় প্রযুক্তির সঙ্গে আর ভবিষ্যতের ছায়া পড়ে রেশমের ভাঁজে। এভাবেই মস্কো ফ্যাশন উইক সমাপ্ত হলো আলো, ইতিহাস আর কল্পনার এক বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। ফ্যাশন এখানে শুধু ট্রেন্ড নয়; এটি উত্তরাধিকার, এটি যেন সময়ের সঙ্গে এক অনন্ত আলাপ।