পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পাওয়াই টার্নিং পয়েন্ট, এখন পড়ছেন অক্সফোর্ডে

রাকিবুল ভূঁইয়া
ছবি: রাকিবুলের সৌজন্যে

রাকিবুল ভূঁইয়ার অক্সফোর্ডে পড়ার স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল একরকম হতাশা থেকেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাওয়াটাই যেন তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। স্মৃতিচারণা করে বলছিলেন, ‘এইচএসসি পরীক্ষার পর যখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চান্স পেলাম না, আইন বিষয়ে ভর্তি হলাম ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। তখন থেকেই ভেতরে–ভেতরে একটা দৃঢ় সংকল্প করেছিলাম, মাস্টার্সের জন্য বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করব। প্রয়োজনে আবেদন করে রিজেক্টেড হব, কিন্তু চেষ্টা না করার আফসোস নিয়ে আমি থাকতে চাইনি।’

আইন পড়ার পথে রাকিবুলের অনুপ্রেরণা বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ও অক্সফোর্ড থেকে ব্যাচেলর অব সিভিল ল ডিগ্রি অর্জন করা ড. কামাল হোসেন। আরও একটি নাম তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে—উপমহাদেশের বরেণ্য রাজনৈতিক নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাঁদের পদচিহ্ন অনুসরণ করাটা একসময় কেবলই স্বপ্নের মতো ছিল রাকিবুলের কাছে। সেই স্বপ্নকে তাড়া করার সাহস তিনি পান ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ সিজিপিএ ও স্বর্ণপদক পাওয়ার পর।

অক্সফোর্ডে যাওয়ার পথে ছিল অসংখ্য ধাপ। আইইএলটিএস, রেফারেন্স লেটার, এসওপি (স্টেটমেন্ট অব পারপাস), ইন্টারভিউ, আরও কত কী! কিন্তু সবচেয়ে কঠিন ছিল এসওপি লেখা। রাকিবুলের মতে, ‘অক্সফোর্ডে যে প্রোগ্রামে আমি ভর্তি হয়েছি, সেটির জন্য যেই এসওপি লিখতে হয়, তার সর্বোচ্চ শব্দসংখ্যা ৩০০। এই ৩০০ শব্দের ভেতর আপনার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—সব গুছিয়ে লিখতে হবে। মাত্র ৩০০ শব্দে সাত বছরের অভিজ্ঞতা কনভিন্সিং গল্প হিসেবে দাঁড় করানোটা প্রচণ্ড কঠিন একটা কাজ।’

রাত জেগে অনেকগুলো খসড়া লিখতে হয়েছে। বারবার শিক্ষকদের দেখিয়েছেন, পরামর্শ নিয়েছেন, সংশোধন করেছেন। অবশেষে অক্সফোর্ড থেকে সুযোগ পেয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ উইডেনফেল্ড-হফম্যান স্কলারশিপ অ্যান্ড লিডারশিপ (ডব্লিউএইচডি স্কলারশিপ) প্রোগ্রামে। এই বৃত্তি শুধু যে পড়ালেখার খরচ বহন করে তা নয়; বরং নেতৃত্বগুণ শেখায়, নৈতিক দর্শন গড়ে তুলতে সাহায্য করে, দেয় উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ।

রাকিবুল বলেন, ‘এই স্কলারশিপ মূলত “ভবিষ্যতের নেতৃত্ব” গড়ে তোলার লক্ষ্যে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের প্রায় এক বছর মেয়াদি কঠোর একটি প্রশিক্ষণ দেয়। স্কলারশিপ কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেছে যে বাংলাদেশ থেকে আমিই প্রথম অক্সফোর্ডের বিসিএল প্রোগ্রামে এই বৃত্তি পেয়েছি।’

রাকিবুলের মতে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো আত্মবিশ্বাসের অভাব ও সঠিক মেন্টরশিপ না থাকা। ‘আমরা অনেক সময় ভয় পাই, চান্স পাব না বা স্কলারশিপ পাব না। এই ভয়ই আমাদের আবেদন করা থেকে বিরত রাখে,’ বলেন রাকিবুল। এ ভয় জয় করতে তিনি নির্ভর করেছিলেন অনলাইন রিসোর্স ও নেটওয়ার্কিংয়ের ওপর। ইউটিউব, লিংকড-ইন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে তিনি তথ্য নিয়েছেন।

অক্সফোর্ডে পৌঁছানোর পর রাকিবুলের অভিজ্ঞতা বেশ অন্য রকম। ‘এখানে ক্লাস হয় সেমিনার স্টাইলে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী একসঙ্গে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেন। শিক্ষকেরা প্রত্যেকের মতামতকে গুরুত্ব দেন। সহপাঠীরা আসেন বিশ্বের নানা দেশ থেকে। তাঁদের ভাবনা, অভিজ্ঞতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে প্রতিদিনের মেলামেশা আমার শেখার পরিধিকে আরও বিস্তৃত করছে।’

রাকিবুল চান, তাঁর এ শিক্ষা যেন দেশের কাজে লাগে। বলছিলেন, ‘আমি এমন এক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করতে চাই, যেখানে মানুষ দ্রুত ন্যায়বিচার পাবে, বছরের পর বছর অপেক্ষার দিন শেষ হবে।’