এআই শুধু ভরসার লাঠি নয়, কোচও হতে পারে

অ্যাঞ্জেলা ডাকওর্থ একজন মার্কিন শিক্ষাবিদ ও মনোবিজ্ঞানী। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার সমাবর্তনে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি।

অ্যাঞ্জেলা ডাকওর্থ
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

প্রিয় স্নাতকেরা, তোমরা অনেকেই অনেক দূর থেকে পেন (সিলভানিয়া) ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছ। আমি কিন্তু কাছেরই একটা ছোট্ট শহরে বড় হয়েছি। আমার হাইস্কুল ছিল অনেকটা সিনেমায় দেখা বড় স্কুলগুলোর মতো—চারদিকে সবুজ মাঠ, মাঝখানে বিশাল একটা সিমেন্টের ভবন।

আমার কাছে পড়াশোনায় সফলতা মানে ছিল পরীক্ষায় সব বিষয়ে এ প্লাস। কল্পনাও করতে পারতাম না যে মজা করে কোনো তথ্যভিত্তিক বই পড়া যায়, বা রাত জেগে এমন কোনো কঠিন বিষয় নিয়ে ভাবা যায়, যেটা পরীক্ষায় আসবে না।

তারপর হঠাৎ করেই একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। ক্লাসের সময়সূচির কারণে আমি একই ইংরেজি শিক্ষককে দুইবার পেয়েছিলাম—একবার সেকেন্ড ইয়ারে, আরেকবার ফাইনাল ইয়ারে। তাঁর নাম ছিল মিস্টার কার। এখানকার অনেক ভালো শিক্ষকের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, মিস্টার কার ছিলেন আমার দেখা সবচেয়ে ভালো শিক্ষক।

সবার চিঠিতে একই কথা

অনেক বছর পর, মিস্টার কার অবসরে যাওয়ার সময় আমরা, তাঁর কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী, একটা চিঠি লিখে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম। আমি শুরু করেছিলাম এভাবে—

‘প্রিয় মিস্টার কার, আপনার ক্লাসেই আমি শব্দের প্রেমে পড়েছিলাম। আমি লেখক হইনি, বড় হয়ে সমাজবিজ্ঞানী হয়েছি। কিন্তু যখনই লিখি, তখনই আপনার শেখানো কথা মনে পড়ে। শুধু তাই না, আপনি যেভাবে লেখালেখি, চিন্তাভাবনা, পড়ানো আর জীবনকে ভালোবাসতেন—সেটাও মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই দিনটির কথা, যেদিন প্রথম জানলাম, কাগুজে লেখার দিকে তাকিয়েও লেখকের কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

আর সেই দিনটিও মনে আছে, যেদিন বুঝেছিলাম—যদি আমি পরিশ্রম করি, নিয়মিত চর্চা করি, আর একটু সৌভাগ্যও থাকে—তাহলে হয়তো একদিন এমনভাবে লিখতে পারব, যেভাবে অন্য মানুষও আমার কণ্ঠ শুনতে পারবে, আমি যা বলতে চাই, বুঝতে পারবে।’

মিস্টার কারকে চিঠিগুলো পাঠানোর আগে একে অপরেরটা আমরা পড়ে নিয়েছিলাম। পড়ে দেখি, সবার লেখায় অদ্ভুত মিল! সবাই বলেছে—মিস্টার কার আমাদের জীবন বদলে দিয়েছেন। তাঁর কৌতূহল ছিল ছোঁয়াচে।

আমার প্রথম চাকরিগুলোর একটি ছিল হাইস্কুলের শিক্ষকতা। যখনই কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতো, ভাবতাম—‘মিস্টার কার হলে কী করতেন?’

আজ, তোমাদের সমাবর্তনের এই বিশেষ দিনেও ভাবছি—যদি মিস্টার কার এখানে থাকতেন, তিনি তোমাদের কী বলতেন? বিশেষ করে আজকের সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে তিনি কী বলতেন?

ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা

মিস্টার কারের যেসব গুণ আমি সবচেয়ে পছন্দ করতাম, তার একটি হলো— প্রায়ই তিনি আমাদের চমকে দিতেন। একবার বললেন, ‘তোমরা সবাই চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ো।’ আমরা পুরো ক্লাস টেবিলের ওপর দাঁড়িয়েছিলাম, যেন পরিচিত কোনো কিছুকে নতুন এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়—এটাই ছিল তাঁর যুক্তি।

তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি আজ এআইকে একটা ভিন্ন দৃষ্টি থেকে দেখতে চাই, যেটা নিয়ে খুব বেশি কথা হয় না। শুরুতেই তোমাদের জন্য আমার একটা প্রশ্ন। যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে হাত তুলবে। প্রস্তুত তো?

প্রশ্নটা হলো—তোমরা কি কখনো ভেবে দেখেছ, এআইয়ের হাতে চিন্তাভাবনার সব কাজ তুলে দিলেও কি তারা কখনো সত্যিকার চিন্তাবিদ হয়ে উঠবে? যারা মনে করো ‘উঠবে না’, তারা হাত তোলো।

অনেকেই হাত তুলেছে। ধন্যবাদ।

তোমরা লক্ষ করলে দেখবে, আমিও হাত তুলেছি। আমি একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আর সাফল্য নিয়ে গবেষণা করি। আমারও চিন্তা হয়। চিন্তা হয়, যে শিশু হাঁটতে শিখছে তার কাছে হুইলচেয়ার যেমন, শিক্ষার্থীদের কাছে এআই-ও যেন তেমন ‘ভরসা’ না হয়ে ওঠে।

আমরা জানি, মানুষের মস্তিষ্ক পেশির মতো—যত ব্যবহার করবে, তত শক্তিশালী হবে। আর ব্যবহার না করলে দুর্বল হয়ে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মনে করেন, এআই শিক্ষাক্ষেত্রে সততা নষ্ট করবে। তার মানে কি ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা অজ্ঞ আর অসৎ হবে?

ভরসা নয়, কোচ

নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এআই শুধু ভরসার লাঠি নয়, কোচও হতে পারে। আমার এক অসাধারণ পিএইচডি শিক্ষার্থী আছে, নাম বেন লিরা। সম্প্রতি সে একটা পরীক্ষা চালিয়েছে—এআই ব্যবহার করে লেখা অনুশীলন করলে কি লেখার দক্ষতা বাড়ে, না কমে। বেনের গবেষণায় একদল শিক্ষার্থী কভার লেটার লিখেছে এআইয়ের সাহায্যে, আরেক দল লিখেছে নিজে নিজে। ফলাফল আমাদের খুবই চমকে দিয়েছে। যারা এআই ব্যবহার করেছিল, তারা তুলনামূলকভাবে কম সময় অনুশীলন করেও বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছিল।

এই ব্যাপারটা ঘটল কীভাবে? সেটা জানার জন্য বেন আরও কিছু পরীক্ষা চালিয়েছে। সে দেখেছে, লেখালেখির ক্ষেত্রে এআই দারুণ এক কোচ হতে পারে, যা ব্যক্তিগতভাবে মানসম্মত উদাহরণ দেখিয়ে শেখায়, যাতে বোঝা যায় ভালো লেখার মান কেমন হওয়া উচিত।

আমি যেহেতু বেনকে এই গবেষণায় সাহায্য করছিলাম, তাই অনেকবার দেখেছি, চ্যাটজিপিটি কীভাবে দুর্বল লেখাকে উন্নত করে। দেখেছি, কীভাবে বড় বড় জটিল বাক্য ছোট করে ফেলে, অপ্রয়োজনীয় পুনরাবৃত্তি বাদ দেয়, এমনকি ধারাবাহিকতা ঠিক রাখতে চিন্তার ক্রমটাও বদলে দেয়। আর জানো কী? এই পুরো প্রক্রিয়ায় আমি নিজেও একজন ভালো লেখক হয়ে উঠেছি।

ঠিক আছে, এখনই মনে হয় বলার উপযুক্ত সময়—এই যে বক্তৃতা আমি আজ তোমাদের দিচ্ছি, এটা নিয়েও আমি এক বা একাধিক এআই চ্যাটবটের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। তোমাদের অনেকেই হয়তো ভদ্রতা করে হাসছ, কিন্তু মনে মনে একটু আঁতকে উঠছ—তোমাদের সমাবর্তন বক্তা কীভাবে এআইয়ের সাহায্য নিয়ে তাঁর বক্তব্য লিখলেন! কিন্তু এটাই সত্যি—আমি নিয়েছি।

আর যেহেতু আমি নিজেই প্রশ্ন করেছিলাম, আর পরামর্শগুলো গ্রহণ বা বাতিল করেছিলাম—তাই এতে আমি মোটেও লজ্জিত নই। বরং আমি গর্বিত—কারণ, আমি এআই ব্যবহার করেছি খোলাখুলি, উন্নত হওয়ার লক্ষ্যে, প্রতারণা ছাড়া।

স্নাতকেরা, তোমাদের সামনে এমন একটা চ্যালেঞ্জ আছে, যেটা আগের কোনো প্রজন্মের ছিল না। সেটা হলো—কীভাবে জিপিটির মতো টুলগুলো শিক্ষার্থীদের ভাবনাকে গভীর করবে, ধ্বংস করবে না।

আমি চাই না তোমরা প্রযুক্তিবিরোধী হও, আবার চাই না অন্ধভক্তও হও।

আমি চাই তোমরা প্রযুক্তি নিয়ে কৌতূহলী হও, এআই সম্পর্কে সচেতন হও—আর তোমাদের শিক্ষার্থীদেরও সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলো।

শিক্ষকের গুরুত্ব

আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটায় আসি এবার।

পৃথিবীর সব জ্ঞান যখন এক ক্লিক দূরে, শিক্ষার্থীদের তখন শিক্ষক দরকার আগের চেয়েও বেশি। কেন? কারণ, শিক্ষার্থীদের এমন কিছু কঠিন কাজ করা শেখাতে হবে, যেগুলো ভবিষ্যতে তাদের কাজে লাগবে। যদি লক্ষ্য ছাড়া, চিন্তা ছাড়া, দায়িত্বহীনভাবে এআই ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা একপ্রকার ভরসার লাঠি হয়ে যায়। শিক্ষকই হচ্ছেন সেই আদর্শ ব্যক্তি, যিনি শেখাবেন, কীভাবে শিখতে হয়।

কয়েক সপ্তাহ আগে, সেমিস্টার শেষের দিকে আমি আমার শিক্ষার্থীদের একটা গোপন কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম—আমি যত জ্ঞান তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি, তার সবই কিন্তু ইন্টারনেটে বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। গুগল স্কলারে পিডিএফে তোমরা সব পাবে। প্রতিটা হোমওয়ার্ক কোনো না কোনো ব্লগ বা পডকাস্টে আগে থেকেই ছিল। এআইসহ নানা প্রযুক্তির কারণে তুমি যা শিখতে চাও, সবই এখন এক ক্লিকের দূরত্ব।

তাদের চোখ বড় হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমি থামিনি। বলেছি—তবুও আমাকে তোমাদের দরকার। আমাকে দরকার বলে দেওয়ার জন্য—মঙ্গলবার অমুক পড়া শেষ করতে হবে, বৃহস্পতিবার তমুক প্রবন্ধ জমা দিয়ো। আমাকে দরকার তোমাদের এই ক্লাসরুমে জড়ো করার জন্য, একটা নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করার জন্য। যেখানে মোবাইল নেই, ল্যাপটপ নেই—কোনো কিছু আমাদের একে অপরকে সত্যিকারভাবে দেখা থেকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। আমাকে দরকার তোমাকে বলার জন্য, ‘আমি জানি, তুমি পারবে।’

মিস্টার কার

মিস্টার কারের দুটি গল্প বলে শেষ করব।

একদিন তিনি ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে ক্লাসরুমে এলেন। ডেস্কের ও প্রান্তে বসে একজন একজন করে আমাদের প্রত্যেকের চোখে চোখ রাখলেন। তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘মনে রেখো, লাইব্রেরিতে জ্ঞান পাওয়া যায় বিনা মূল্যে, কিন্তু তোমাকে ঠিকই তোমার ঝোলা সঙ্গে করে আনতে হবে।’

এবার দ্বিতীয় ঘটনা। কিছুদিন আগে আমি মিস্টার কারের ছেলে জ্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি নিজেও একজন শিক্ষক। জ্যাককে আমি এই সমাবর্তন বক্তৃতাটা ই–মেইল করে বলেছিলাম, তিনি যেন তাঁর বাবাকে এটা দেখান।

গতকাল বিস্ময় নিয়ে দেখলাম, আমার ইনবক্সে একটা ই–মেইল এসেছে। পাঠিয়েছেন স্বয়ং মিস্টার কার! তাঁর নাম দেখে কী যে আনন্দ হচ্ছিল। ভীষণ রোমাঞ্চ নিয়ে ভাবছিলাম—তিনি কি আমার বক্তৃতাটা দেখে খুশি হলেন? কী বললেন? দম বন্ধ করে ই–মেইল খুললাম। তিনি লিখেছেন—

‘আঞ্জেলা, তুমি তোমার বক্তৃতাটি পাঠিয়েছ বলে ধন্যবাদ। এআই নিয়ে তোমার পর্যবেক্ষণগুলো খুবই আশাব্যঞ্জক। আমি সম্প্রতি জ্যাককে লিখেছি, সে যে শিক্ষক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এতে আমি ভীষণ গর্বিত। আমি এখনো শিক্ষকতার পক্ষে। তোমার কথাগুলো আমাকে বিনীত করেছে। আশা করি, আমি এই কথাগুলোর যোগ্য। শিক্ষকতা করতে সাহস লাগে। আর পাশে একজন বন্ধু থাকলে সেটা সহজ হয়। যদি নিজেকেই উদ্ধৃত করি—বন্ধুত্ব আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। শুধু বুঝে নিতে হবে, আমরা একসঙ্গে আছি। শুধু হাত বাড়াতে হবে। এই গ্রীষ্ম আর ভবিষ্যৎ দিনগুলো তোমাদের জন্য আশীর্বাদময় হোক। ধন্যবাদ।’

ইংরেজি থেকে অনূদিত

সূত্র: বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউটিউব চ্যানেল