
লোহার লম্বা লম্বা শিক দেওয়া জানালার ওপাশেই ছিল একটা উঁচু তালগাছ। আমাদের দোতলার ফ্ল্যাটের জানালার নিচে সবুজ একচিলতে মাঠ। তাতে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় পাড়ার বিড়ালগুলো। ঝাঁকে ঝাঁকে দানা খেতে আসে চড়ুই আর শালিক। ওই একচিলতে সবুজ পেরিয়ে কলোনির টানা হলদে দেয়াল। দেয়াল পেরিয়ে রাস্তা, রাস্তার বিপরীতে ইডেন কলেজ। ওপারের ওই দেয়াল ঘেঁষে সারা দিন ইডেনের মেয়েদের ব্যস্ত আনাগোনা। তাঁরা দেখতে কী সুন্দর! আর কী উচ্ছল! দোতলার ওই লোহার শিক দেওয়া জানালার পাশে বসে বালিকা বয়সে সেই উচ্ছল আনন্দোচ্ছ্বাস দেখতাম। ভাবতাম, কবে বড় হবো ওদের মতো। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াব আর পরব অমন রঙিন আধুনিক পোশাক-আশাক?
জানালার পাশের উঁচু তালগাছটার চিরল চিরল পাতার ফাঁক গলে বিকেলের সোনাগলা রোদ্দুর এসে ভাসিয়ে দিত ঘর। সেই রোদ ধীরে ধীরে নরম আর কোমল হয়ে উঠত। সেই সময় আসরের আজান দিলেই ছুটে সবাই নিচে নামতাম খেলতে। সবাই অবশ্য আমাদের মতো নয়। সামনের দালানের তিনতলার মেয়েটি তখন রুটিনমাফিক হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধতে বসত। পূরবী রাগের আঁকাবাঁকা সুর এদালান–ওদালান গলে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত কুয়াশার চূর্ণের মতো। মেয়েটি মাঝেমধ্যে রেডিও–টিভিতেও গাইত। আর আমাদের নিচতলার ময়না আপু ইজেলে কাগজ লাগিয়ে ছবি আঁকতে বসতেন। মাঝেমধ্যে বিকেলে খেলতে না গিয়ে আমি তাঁর ছবি আঁকা দেখতে যেতাম। সামনের বিল্ডিংয়ের দোতলায় থাকতেন তৎকালীন পিজি হাসপাতালের এক অধ্যাপক, নামকরা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। তাঁর ছেলেমেয়েরা দারুণ মেধাবী। বোর্ডে প্লেস করা সব ছাত্রছাত্রী। পড়াশোনা ছাড়া কদাচিৎই তাদের খেলতে নামতে দেখা যেত। আমাদের মা–বাবাদের কাছে তারা ছিল আদর্শ। তাদের পা ধোয়া পানি খাওয়ার পরামর্শ মিলত প্রায়ই। কিন্তু আমি ঘুরঘুর করতাম তাদেরই পাশের ফ্ল্যাটের দুর্দান্ত সুন্দরী দুটি মেয়ের পেছনে। দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। খুব সুন্দর করে সব সময় সেজেগুজে থাকত তারা। আর ছিল দারুণ স্মার্ট। বলা বাহুল্য, পাড়ার ছেলেরাও আমারই মতো দুই বোনের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল। কিন্তু সুন্দরী আপারা মোটেও কাউকে পাত্তা দিতেন না। একদিন হাসতে হাসতে আমাকে বলেছিলেন, ‘আরে বুয়েট পাস ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া প্রেম-ট্রেম করব না, বুঝলি!’ বুয়েটের ছেলেরা তখন সব তরুণীর আরাধ্য।
আজিমপুরে তখন কাক আর চিল ছিল অনেক। দিনের কাজ সেরে গোসলে ঢুকে চেঁচিয়ে উঠত আমাদের রূপবান বুয়া, ‘হারামি কাউয়া আবার আমার সাবান চুরি করছে খালাম্মা।’
আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, কাকেরা সাবান চুরি করে কেন? কোথায় নিয়ে যায় তারা চুরি করা সব জিনিস?
শীতকালে নেট টানিয়ে বাল্ব জ্বেলে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো নিচে। আমাদের কারও কারও খেলাধুলায় অনীহা, বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করতেই মূলত নিচে নামা। কত রকমের গল্প ছিল আমাদের। হুমায়ূন আহমেদ বা সুনীল চালাচালি হতো পরস্পরের মধ্যে। বড় হচ্ছি বলে তখন আমরা রূপা বা হিমুকে ছেড়ে বেশি ভক্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছি দীপাবলী বা জয়িতার। আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি–সত্যবতী–বকুল কথা’ দিয়ে আমাদের নারীবাদের পাঠ শুরু হয়েছে। মায়েদের পছন্দ নয়, কিন্তু লুকিয়ে পড়া শুরু করেছি তসলিমা নাসরিনের বই। রুদ্রর কবিতা মন উচাটন করে দিচ্ছে। সোলস, চাইম কিংবা ডিফারেন্ট টাচের রোমান্টিক গানগুলো মুখে মুখে ফেরে। এরই মধ্যে সুমন-নচিকেতা এসে গানের কানই বদলে দিলেন। কিন্তু এই এত বিষয়ে গল্প–গসিপ শেষ হওয়ার আগেই মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি বারান্দা আর জানালা দিয়ে ডাক পড়ত মায়েদের, ‘আরে শিগগির এসো, হাত–মুখ ধুয়ে পড়তে বসো, পরীক্ষা সামনে, আরে কী হলো, এবার কিন্তু সত্যি মার খাবে…।’
অনেক দিন পর দু’বছর আগে বৃক্ষহীন, গুল্মহীন শূন্য সেই জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হয়েছিল যেন দোতলার জানালা থেকে আম্মা ডাকছেন রাগী কণ্ঠে, ‘সামনে বার্ষিক পরীক্ষা, এখনো গল্প চলছে? ওপরে এসো বলছি।’
ঘোর ভাঙলে দেখি কোথাও কিছু নেই। ভেঙে ফেলা হয়েছে পুরোনো সব সাদা চারতলা দালান, যেসব দালানের সামনে ছোট করে লেখা থাকত বিল্ডিংয়ের নম্বর, আমাদের নম্বর ছিল চৌষট্টি। সেই টানা গ্রিল দেওয়া বারান্দা, লোহার শিক দেওয়া বড় বড় জানালা, লাল রঙের মেঝে—কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। আমার আশৈশব নিকটজন উঁচু তালগাছটাসহ কোনো গাছই আর সেখানে চোখে পড়ে না। কয়েক বছর আগেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঢাকার প্রথম সরকারি আবাসন প্রকল্প আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টার। এখানে নতুন আধুনিক সুউচ্চ আবাসন প্রকল্প হয়েছে। বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে কলোনির মধ্যে টলটল করতে থাকা পুকুরগুলোও। হাইরাইজ নতুন সরকারি অ্যাপার্টমেন্টগুলোর ফাঁকফোকরে মাথাভর্তি স্মৃতির টুকরাগুলো কেন যেন পথ হারাতে থাকে।
আজিমপুর কলোনি এ দেশে বহুতলবিশিষ্ট গুচ্ছ আবাসনের প্রথম প্রকল্প। মুনতাসীর মামুন ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ধরে নেয়া হয় মুঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজিমপুর। ১৮৫০ সালে সার্ভেয়ার জেনারেলের মানচিত্রে আজিমপুর ছিল বসতিহীন অঞ্চল। আজিমপুর নামকরণ নিয়েও বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা আজমের নামানুসারে নাম করা হয়েছিল এ অঞ্চলের। ১৬৭৭-৭৯ সাল পর্যন্ত শাহজাদা আজম ছিলেন বাংলার সুবাদার। তিনিই শুরু করেছিলেন কিলা আওরঙ্গবাদ বা লালবাগ দুর্গ নির্মাণের কাজ। তাঁর কর্মচারীরা বসবাস করতেন এ এলাকায়, আর তখন থেকে এলাকাটি আজমপুরা নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের ফলে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক রাজধানী হয় ঢাকা। নবঘোষিত রাজধানীতে সরকারি দপ্তরের সংস্থান ও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের আবাসন একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় তখন। সরকারি কর্মচারীদের আবাসিক চাহিদা নিরসনের জন্য ঢাকার আজিমপুর এলাকায় প্রথম আবাসিক প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথম প্রকল্পটি ছিল আজিমপুর রোডের দক্ষিণাংশে। আজিমপুর চৌরাস্তা বা ইডেন কলেজ মোড়ের পশ্চিম–দক্ষিণ এলাকাজুড়ে। পরে ৫০-এর দশকে আজিমপুর রোডের উত্তর পাশ থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকায় এই আবাসিক প্রকল্পের বিস্তার ঘটানো হয়। অবশ্য নিউমার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৫২ সালে, শেষ হয় ১৯৫৪ সালে। ধারণা করা হয়, পুরান ও নতুন ঢাকার সংযোগস্থলে এই বিশাল মার্কেট স্থাপনার পেছনেও ছিল আজিমপুর কলোনির বাসিন্দাদের বাজার-সদাই করার সুবিধা।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিল্ডিং (নভেম্বর ১৯৫০) সাময়িকীতে কোলম্যান হিকসের ‘ফ্ল্যাটস ইন ঢাকা’ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে যে আজিমপুর এস্টেট নির্মাণ প্রকল্পটি শুরু থেকে শেষ অবধি একটি পথপ্রদর্শক বা পাইওনিয়ারিং পদক্ষেপ ছিল। এশিয়ার অন্যান্য দেশে নির্মাণশিল্প যখন স্থবির প্রায়, তখন অনগ্রসর পূর্ববাংলার ঢাকা শহরে সম্পূর্ণ প্রকল্পটি রেকর্ড সময়ে শেষ করা হয়। তিন কক্ষবিশিষ্ট ৪৮টি এবং ৩৮টি ব্লকে দুই কক্ষবিশিষ্ট ৪৫৬টি ফ্ল্যাট এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৯-এর জানুয়ারিতে শুরু হয়ে ওই বছরের অক্টোবরে শেষ হওয়া এ প্রকল্পে দেখা যায়, গড়ে প্রতিদিন প্রায় দুটি ফ্ল্যাট সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় ছিল মাত্র ৭৫ লাখ টাকা!
পবিত্র রমজান মাস এলে মনে হতো ঈদ এসে গেছে। কলোনিতে রাত নামত না কখনো। মাঝরাত থেকে কলোনির ভেতরকার রাস্তায় গান গেয়ে ঘুম ভাঙাত কাসিদা দল। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে ভয়ে আঁতকে উঠতাম তাঁদের হেঁড়ে গলা শুনে। দালানে দালানে আলো জ্বলে উঠত মধ্যরাত থেকে। রান্নাঘরগুলোতে ব্যস্ততা, টুং টাং। মাইক্রোওয়েভের চল শুরু হয়নি বলে সবাই রাতে উঠেই সাহ্রির রান্না করতেন। ইফতারে, শবে বরাতে এ ফ্ল্যাট থেকে ও ফ্ল্যাটে সুন্দর করে সাজানো জরির ঢাকনা দেওয়া ট্রেতে খাবার নিয়ে অবিরাম যাওয়া–আসা চলত। আনা–নেওয়ার দায়িত্বটা আমাদের মতো ছোটদের ওপর ছিল বলে সেটা ছিল খুব আনন্দের বিষয়। মহররমের মেলা বসত আজিমপুরের শেষ মাথায়, শেখ সাহেব বাজারের কাছে। মেলায় মিলত নিত্যদিনের নানা পণ্য, গৃহস্থালি জিনিস। আম্মা আর আন্টিরা হেঁটে গিয়ে টুকটাক কেনাকাটা করতেন। কলোনির পাশেই তো নিউমার্কেট। ঈদের বাজার-সদাই সব নিউমার্কেট থেকেই, দরজিবাড়ি আর চাঁদনী চকে। আব্বা বিকেলে হেঁটে গিয়ে নিউমার্কেট থেকে আনতেন অলিম্পিয়ার টোস্ট বিস্কুট আর পাউরুটি, মেহমান আসার কথা থাকলে হট প্যাটিস আর প্লেন কেকও আসত। তখন ফাস্ট ফুড বলতে ছিল এই হট প্যাটিস বা ক্রিমরোল।
আমাদের চারটা দালান পর ৫২ নম্বরে থাকতেন আমার মামা-মামি। বদরুননেসা কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক মামি আমার সব মুশকিল আসানের কারিগর। স্কুলে গানের ক্লাস মিস করেছি, এখন পরীক্ষার আগে রবীন্দ্রনাথের ‘চিনিলে না আমারে কি’ গানটা কে তুলে দেবে? তখন তো আর ইউটিউব নেই। মামি বললেন, ‘মনে হয় চিন্ময়ের গলায় শুনেছি না গানটা? চল এলিফ্যান্ট রোডের গানের ডালি থেকে চিন্ময়ের ক্যাসেট কিনে আনি, তারপর দেখা যাবে।’
ফিতাওলা সেই সব ক্যাসেট এখনকার টিনএজাররা চোখে দেখেনি। মামির খালাতো বোন প্রায়ই আসতেন তাঁর বাসায়, দুর্দান্ত গাইতেন তিনি, তার চেয়ে বেশি বিখ্যাত ছিলেন বিতার্কিক হিসেবে, সেই নাফিয়া খালাই শেষে হারমোনিয়ামে তুলে দিলেন গানটা। ‘চিনিলে না আমারে কি, চিনিলে না!’
সিটি করপোরেশনের ট্রাক যেদিন মগবাজারের রাস্তায় চাপা দিল মেধাবী বিতার্কিক নাফিয়া খালাকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সতীর্থরা কেঁদে আকুল হলো, মিছিল করল, প্রতিবাদে মুখর হলো, তখন আমার কানে বাজছিল চিন্ময়ের গলায় সেই গান, ‘মোর ভাগ্যতরী এটুকু বাধায় গেল ঠেকি!’
৬৬–তে থাকতেন সাহিত্যিক বেগম মমতাজ হোসেন (তাঁর লেখা ধারাবাহিক নাটক ‘সকাল-সন্ধ্যা’ তখন বিটিভিতে তুমুল জনপ্রিয়) আর তাঁর বোন আমাদের অগ্রণী স্কুলের শিক্ষক নীলুফার বেগম। তাঁদের বিখ্যাত ভাই চিত্রপরিচালক আলমগীর কবিরের ফেরিঘাটে পড়ে গিয়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর পর লাশ আজিমপুরেই আনা হয়েছিল। সবাই ছুটে গিয়েছিল সান্ত্বনা জানাতে। এত মানুষ জমেছিল যে আশপাশের সব ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বসানো হয়েছিল সব অতিথিকে। তখন আমরা চোর–ডাকাতের ভয় অত করতাম না। আজিমপুর কোয়ার্টার বেশ নিরাপদ ছিল। আর সবাই সবার পরিচিত ছিল। তা তিনি যে কত বড় মাপের গুণী পরিচালক, তা বোঝার বয়স হয়নি বালিকাদের, আমরা বরং দুঃখে মরে যাচ্ছিলাম আলমগীর কবির-জয়শ্রী কবিরের একমাত্র সন্তান কটা চোখের হ্যান্ডসাম কিশোর ছেলে লেনিনকে দেখে! আহা, কী হবে এখন ছেলেটার!
৫৯ নম্বরের চারতলায় প্রায় রোজ যেতাম আমার ক্লাসমেট আর প্রাণের বন্ধু মৌসুমীর বাসায়। তাদের নিচতলায় থাকতেন আমাদের অগ্রণী স্কুলের বাংলার শিক্ষক কামরুন নাহার আপা আর তাঁর স্বামী বড় অভিনেতা ও মঞ্চব্যক্তিত্ব মমতাজউদদীন আহমদ। অনেক অনেক বই ছিল তাঁদের বাসায়। একটা বড় ইজিচেয়ারে বসে অবিরাম পা দোলাতে দোলাতে বই পড়তেন মমতাজউদদীন চাচা। আর তাঁদের মেয়ে তাহিতি আপা ছিলেন আমাদের এক বছরের বড়। অগ্রণী স্কুলে তাহিতি আপা আর ত্রপা (মজুমদার) আপা ছিলেন হরিহর আত্মা। সারাক্ষণ একসঙ্গে ঘুরতেন। এই দুজনকে আমরা ভারি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার চোখে দেখতাম। খুব গুণী আর মেধাবী দুজন তরুণী। ইডেনের উল্টো গেট দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকের প্রথম বিল্ডিংয়ের নিচতলায় থাকতেন দিলারা জামান। তাঁর বড় মেয়ে তানি আপা পড়তেন ডেন্টালে, কিন্তু আমার বেশি ভালো লাগত ছোট মেয়েটাকে। খুবই চঞ্চল ছিল সে। সারাক্ষণ হাসত। আজিমপুর কলোনিতে আমরা সবাই হয় অগ্রণী স্কুলে পড়তাম, নয়তো আজিমপুর সরকারি গার্লস স্কুলে। ছেলেরা বেশির ভাগ গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে। কাছাকাছি বা পাড়ার স্কুলেই পড়ার প্রবণতা ছিল তখন, দূরের স্কুলে ভর্তি হওয়ার চল ছিল না। সবাই হেঁটে বা ঘণ্টা বাজার একটু আগে দৌড়ে স্কুলে যেতাম। সকাল আটটা আর বেলা একটার পর কলোনির ভেতরকার সব পথ ভরে উঠত নীল ড্রেস পরা অগ্রণীর মেয়েদের কলকাকলিতে। আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষকেরাও থাকতেন এ পাড়াতেই। গণিতের শিক্ষক ননীগোপাল স্যার বা পরে ঢাকা কলেজের বাংলার শিক্ষক নাসিম বানু ম্যাডাম, কিংবা জুওলজির জিক স্যার—হেঁটে হেঁটেই পড়তে যেতাম তাঁদের বাসায়।
একবার সূর্যগ্রহণ হলো। দিনের বেলায় অন্ধকার হয়ে এল চরাচর। কতজনের কত কথা, কত গুজব। সূর্যগ্রহণের সময় নাকি আকাশের দিকে তাকালে চোখ অন্ধ হয়ে যায়। তাই একজন বিজ্ঞ বড় ভাই ব্যবস্থা করলেন, গামলা আর বালতিভর্তি পানি রাখা হবে, সেই পানিতে সূর্যগ্রহণ দেখা হবে। দুপুর থেকে যার যার বাড়ি থেকে গামলা বালতি নিয়ে সবাই নিচে নেমে হুড়োহুড়ি। কে যেন বলল এক্স–রে প্লেটের ভেতর দিয়েও দেখা যাবে। কলোনিতে আমাদের শৈশব ছিল এই সব নিত্যনতুন নানা কর্মকাণ্ডে মুখর।
’৮৮-র বন্যায় ঢাকা শহর ডুবে গেলেও আজিমপুর কলোনি ডোবেনি। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকের আত্মীয়স্বজন এসে উঠেছিল বিভিন্ন ফ্ল্যাটে। পাড়ার ছেলেরা প্রতি বাড়ি থেকে রুটি–তরকারি সংগ্রহ করতে লেগে যেত। প্রতি ফ্ল্যাটে সকাল থেকেই তৈরি হয় ২০, ৩০, ৫০টা করে আটার রুটি, সঙ্গে সবজি বা সুজির হালুয়া। ছেলেরা সেগুলো নিয়ে যায়, বন্যার্তদের মধ্যে বিলানোর জন্য। রুটি তৈরি আর বিলানোতে কারও উৎসাহের কমতি নেই। এখানে তো সব সরকারি কর্মকর্তাদের আবাস। তাই এরশাদবিরোদী কঠোর আন্দোলন ও হরতালেও আব্বাসহ সব কর্মকর্তা হেঁটে অফিস করতে যেতেন। হরতাল খুব কঠোর হতো তখন। পথে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও ছিল। তবু তাঁদের যেতে হতো। তখন সরকারি কর্মকর্তারা দলীয় রাজনীতি করার কথা ভাবতেও পারতেন না। কিন্তু কলোনির ছেলেমেয়েরা ছিল উত্তাল। মুহুর্মুহু মিছিলে প্রকম্পিত হতো রাস্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মিছিলে মিশে যেত ইডেন কলেজ আর আজিমপুর কলোনির ছেলেমেয়েরা। বেশ মনে পড়ে, এরশাদের পতনের দিন তো ছোট–বড় সবাই নেমে এসেছিল রাস্তায়, অনেক রাত অবধি আনন্দ আর হইচই হয়েছিল। মিষ্টি খাওয়াখাওয়ি হয়েছিল।
সরকারি কর্মকর্তাদের বাসস্থান হলেও আজিমপুর কলোনি ছিল এ দেশের নানা আন্দোলন–প্রতিবাদের সূতিকাগার। এ বি এম সিদ্দিক চৌধুরীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যাচ্ছে, ‘আমি ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে সন্দ্বীপ হতে ঢাকায় এসে ১২/এফ আজিমপুর কলোনীতে উঠি। ওই বাসাটি আমার বড় দুলাভাই স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার মুহাম্মদ আমিন উল্যার নামে বরাদ্দ ছিল। আমার আর এক বন্ধু জোয়াদুল করিমও (তনু) ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কুষ্টিয়া হতে ঢাকায় এসে ২/সি আজিমপুর কলোনীতে উঠেন। ওই বাসাটি তাঁর ছোট ভগ্নিপতি সিআইডির অফিসার আবদুস সামাদের নামে বরাদ্দ ছিল। আমাদের এক বছরের সিনিয়র বাগেরহাটের ওয়াজেদ হোসেন ১২/ই, আজিমপুর কলোনীতে তাঁর মামা সিআইডির অফিসার সেকান্দর আলি সাহেবের বাসায় থেকে জগন্নাথ কলেজে বিকম পড়তেন। আমরা তিনজন একসাথে কলেজে আসা-যাওয়া করতাম এবং একসাথে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আমরা যোগদান করি।’
সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও এগিয়ে ছিল আজিমপুরবাসীরা। সরকারি কোয়ার্টারকে ঘিরে ১৯৫৬ সালে গড়ে উঠেছিল ‘আজিমপুর লেডিস ক্লাব’। কলোনির ভেতরে লেডিস ক্লাবে সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা ইত্যাদি শেখানো হতো। দিবসগুলোতে নিয়ম করে অনুষ্ঠান হতো। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রকাশিত ‘ঢাকা মহানগরী নাট্যচর্চা’ গ্রন্থে দেখছি: সে সময় নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন পুরুষেরা। অবশেষে আজিমপুর কলোনির শিরিন চৌধুরী এগিয়ে এলেন। এই দুঃসাহসের জন্য তাঁর স্বামী ও তাঁর পরিবারকে দুঃসহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। নাটকটি ১৯৫৯ সালে ভিক্টোরিয়া পার্কে মঞ্চস্থ হয়েছিল। নাটকে মহিলা শিল্পী আছে জানতে পেরে তৎকালীন একমাত্র মঞ্চ মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ নাটকটি মঞ্চস্থ করার অনুমতি দেয়নি। বাধ্য হয়ে খোলা ময়দানে মঞ্চ বেঁধে নাটকটি মঞ্চস্থ করতে হয়েছিল!
১৯৫৭ সালের ২১ জানুয়ারি ড. কাজী আনোয়ারা মনসুর আজিমপুর কলোনির ভেতর মাঠে তাঁবু টানিয়ে ১৪ জন শিশুকে নিয়ে শুরু করেন আজিমপুর কিন্ডারগার্টেন। ১৯৬৭ সালে এটি পরিণত হয় অগ্রণী গার্লস স্কুলে। স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকার অন্যতম প্রসিদ্ধ মেয়েদের স্কুলের সুখ্যাতি অর্জন করে অগ্রণী স্কুল। অগ্রণী স্কুল কেবল আমাদের আধুনিক লেখাপড়ার ভিত গড়ে দেয়নি, এই স্কুলে নিয়মিত হতো গান, ছবি আঁকা, সেলাই ও রান্নার ক্লাস, স্পোর্টস ছিল বাধ্যতামূলক। বড় আপা ও টুলু আপা—দুই বোনেরই স্বপ্ন ছিল, অগ্রণীর মেয়েরা মাল্টিপল স্কিলে গড়ে উঠবে। আশির দশকে টুলু আপা নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে স্কুলে আসতেন। তাঁর হাই হিলের শব্দ ছিল আমাদের জন্য চরম আতঙ্কের। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গাড়ি আসত প্রতি বৃহস্পতিবার, আর আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়তাম নতুন বইয়ের আশায়। আজিমপুরের প্রায় সব মেয়ের রুচি ও মনন গড়ে দিয়েছে এই স্কুল।
১৯৫২ সালে কলোনির ভেতর চালু হয় কিন্ডারগার্টেন লিটিল এঞ্জেলস স্কুল। ড. আমেনা রহমান ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৩ সালে কলোনির মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয় আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টার। ঢাকায় তখন হাতে গোনা কয়েকটি কমিউনিটি সেন্টার ছিল। ঢাকার বিখ্যাত ও গণ্যমান্য লোকেদের বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানের সাক্ষী এটি। হতো নানা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পুরোনো কোয়ার্টারের সঙ্গে ভেঙে ফেলা হয়েছে এটিও।
শহর বদলায়। শহর ভাঙে আবার গড়ে ওঠে। আর এই ভাঙা–গড়ার খেলায় মুছে যায় আমাদের শৈশব। হারায় পূরবী সন্ধ্যা রাগের সুর, অলস দুপুরে মায়েদের বিছানায় এলিয়ে ‘বেগম’ পড়া, ভিসিআরে অমিতাভ-রেখার হিট সিনেমা দেখার উদ্দেশ্যে কলোনির আন্টিদের অগ্রিম কর্মতৎপরতা। হারিয়ে যায় পুকুরের জলের ছায়ায় সূর্য দেখা, তালপাতার ফাঁকে রোদ্দুরের ঝিকিমিকি। অলিম্পিয়ার হট প্যাটিস আর আন্টিদের হাতের শবে বরাতের হালুয়া। ঢাকার কাক আর চিলেরা তো কবেই হারিয়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমরা আজিমপুর কোয়ার্টারের দীর্ঘ বাস ছেড়ে ধানমন্ডি চলে এলাম। সেটাও সরকারি বাসা, কলোনির বাসার চেয়ে অনেক বড় আর সুপরিসর। কিন্তু আমাদের মন পড়ে থাকত আজিমপুরে। এখানেই গড়ে উঠেছিল আমাদের শৈশব! আমাদের হৃদয়টাও গড়ে দিয়েছিল এই কলোনি।
এখন মনে হয়, এক হারিয়ে যাওয়া শহরে নিজেকে খুঁজে ফিরি। যে শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু, সেই ঢাকা, সেই শহরকে আজও ভালোবাসি, কিন্তু তার কত কিছু যে হারিয়ে গেল চোখের সামনে! হারিয়ে গেল সেই আদি আজিমপুর কলোনিও। আমারই মতো হয়তো সৈয়দ শামসুল হকও খুঁজতেন তাঁর প্রিয় শহরকে—
সে আছে কোথায়?
কোথায় খুঁজব আমি, সে থাকে কোথায়?
কোন মহল্লায়?
শহরের কোন কলোনিতে?
একবিংশ শতাব্দীর থাকে সে কোন অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে?
(আমার শহর: সৈয়দ শামসুল হক)