
মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে এআই টুলগুলো নিজেরাও প্রতিনিয়ত শিখছে। তাই মানুষের সঙ্গে চ্যাটবটের কথাবার্তার ধরন দিন দিন হয়ে উঠছে আরও বেশি মানবিক এবং বাস্তবসম্মত। কিন্তু তারপরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। এআইয়ের মতো এত সম্ভাবনাময় একটি প্রযুক্তিকে মানসিক সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করা কি ঠিক? ঠিক হয়ে থাকলে এর সীমারেখা কী? সব ধরনের মানসিক সমস্যার জন্য এআইয়ের কাছে পরামর্শ চাওয়া কি নিরাপদ?
এখন প্রায় সব ধরনের কাজেই এআই ব্যবহার করা হচ্ছে। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ক্যারিয়ার গাইডলাইন তৈরি, সিভি লেখানো থেকে শুরু করে নিজের পছন্দ অনুযায়ী ভ্রমণের পরিকল্পনা, কোনো বেলায় বেঁচে যাওয়া খাবার দিয়েই নতুন কোনো খাবার তৈরি করার রেসিপি নেওয়া—এ রকম ছোট–বড় প্রায় সব কাজের জন্যই মানুষ এআইয়ের দ্বারস্থ হচ্ছে। এআই খুলে দিয়েছে অসীম সম্ভাবনার দুয়ার।
অতি সম্প্রতি ভারতের নানাবতী ম্যাক্স সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের হেড অব ইমেজিং ডাক্তার দীপক পাটকার এক সাক্ষাৎকারে মানসিক সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে এআই চ্যাটবটের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কোন কোন পরিস্থিতিতে এআইয়ের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে, কখন যাবে না, এসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় তাঁর সাক্ষাৎকারে।
এআই পাওয়া যায় হাতের নাগালে, ব্যবহার করাও সুবিধাজনক। অতি সহজ একটি প্রম্পট লিখেই এআইয়ের কাছ থেকে আমাদের ব্যক্তিগত চাহিদা মেটানোর উপযোগী উত্তর পাওয়া যায়। এআইয়ের এই সুবিধার কথা উল্লেখ করে দীপক পাটকার বলেন, ‘যেসব এআই চ্যাটবট মেশিন লার্নিং এবং ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে কাজ করে, সেসব চ্যাটবট সবার কাছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে দিচ্ছে। মানসিক সহায়তা পাওয়ার জন্য অনেকে প্রথমেই এআইয়ের দ্বারস্থ হচ্ছেন। কারণ, এআই খুব চমৎকারভাবে দ্রুত উত্তর দেয়। কোনো ব্যক্তিকে বিচার বা তার দুরবস্থার জন্য তাকেই দোষারোপ করার প্রবণতাও চ্যাটবটগুলোর মধ্যে নেই। এই বিষয়টি যেকোনো মানসিক সংকট প্রাথমিকভাবে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রাথমিক সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে এআই চ্যাটবটের কাছ থেকে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ নেওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, অতটা তীব্র নয়, এমন সমস্যা (যেমন দুশ্চিন্তা কিংবা অবসাদ) দূর করার ক্ষেত্রে চ্যাটবট কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
সাইকোথেরাপির প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি বেশ জনপ্রিয়। মুঠোফোনের কিছু অ্যাপেও কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপির সুবিধা মেলে। এসব অ্যাপ ব্যবহারকারীদের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা চিহ্নিত এবং মোকাবিলা করতে সহায়তা করে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। মানসিক রোগের চিকিৎসা নেওয়ার বেলায় অনেকের মধ্যেই অনীহা দেখা যায়। এসব অ্যাপ মানসিক রোগের চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে সমাজের ভ্রান্ত ও নেতিবাচক ধারণাগুলো দূর করতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এ ছাড়া চ্যাটবটগুলো আবেগ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে পরামর্শ দিতে এবং ধারাবাহিকভাবে একজন ব্যক্তির মানসিক অবস্থাসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করতে সক্ষম তো বটেই।
কিছু নির্দিষ্ট সমস্যার ক্ষেত্রে এআই পর্যাপ্ত সহযোগিতা করতে পারে না। কিছু কিছু জটিল সমস্যা সামাধানের ক্ষেত্রে একজন পেশাদার মনোবিদের জ্ঞানের গভীরতা এবং পারদর্শিতার তুলনায় এআইয়ের ক্ষমতা নিতান্তই সীমিত। দীপক পাটকারের মতে, চ্যাটবটগুলো জটিল মানসিক রোগ নির্ণয় ও নিরাময় করতে সক্ষম নয়। কারণ, মানুষের মন বুঝতে পারার জন্য প্রয়োজনীয় সহমর্মিতা আর বোধশক্তি চ্যাটবটের নেই। অনলাইনে পদে পদে যেখানে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেখানে চ্যাটবটের কাছে ব্যক্তিগত মানসিক সমস্যার কথা বলা কতটা নিরাপদ, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এ ছাড়া চ্যাটবট অনেক সময় মানুষের বক্তব্য বুঝতে ভুল করে। গুরুতর এবং নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো সামাল দিতেও চ্যাটবট অপারগ।
তাহলে উপায় কী? চ্যাটবট কি মোটেও ব্যবহার করা যাবে না? চ্যাটবট ব্যবহার অবশ্যই করবেন। কিন্তু আপনাকে জানতে হবে চ্যাটবটের পরামর্শের ওপর কখন, কতটা আস্থা রাখা যায়। এ বিষয়ে দীপক পাটকারের মত হচ্ছে চ্যাটবটের কাছে ছোটখাটো ব্যাপার, যেমন কীভাবে অবসাদ কমানো যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া যেতে পারে। একজন মনোবিদের তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় যদি আপনি চ্যাটবটের সাহায্য নেন, তাহলে চ্যাটবট চমৎকার কাজ করবে। কিন্তু চ্যাটবট কখনোই একজন মনোবিদের বিকল্প হতে পারে না।
কারও আত্মঘাতী হয়ে ওঠার প্রবণতা থাকলে, মানসিকভাবে চরম অশান্তিতে থাকলে, কখনোই মন ভালো না থাকলে অবশ্যই পেশাদার মানসিক চিকিৎকের কাছে যেতে হবে। চ্যাটবট শুধু ব্যক্তির অনুভূতি সম্পর্কে আরও জানার একটি মাধ্যম হতে পারে, কিন্তু গুরুতর সমস্যাগুলোর সমাধান হতে পারে না।
সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস