সুন্দর, সুস্থ ও তারুণ্যোজ্জ্বল ত্বকের কামনা আমাদের সবার। কিন্তু সঠিক জ্ঞান ও পরিচর্যার অভাবে প্রায় সময় ত্বকের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ত্বকের কোনো সমস্যায় আমাদের কী করা উচিত, কোন মৌসুমে ত্বকের যত্ন কী রকম হবে, এ নিয়ে সবাইকে বিস্তারিত জানাতে শুরু হলো বিশেষ অনুষ্ঠান এসকেএফ নিবেদিত ‘ত্বক আলাপন’। প্রথম পর্বের বিষয় ছিল ‘গ্রীষ্ম ও বর্ষায় ত্বকের সমস্যা ও পরিচর্যা’।
মীর আর্সিয়া জামানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের কনসালট্যান্ট চিকিৎসক মাহমুদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি ৭ জুন প্রথম আলো এবং এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
এখনকার অবস্থা—এই গরম, এই বৃষ্টি! আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন ত্বকের ওপর বেশ প্রভাব ফেলে। দেখা দেয় নানা ধরনের সমস্যা। অনুষ্ঠানের শুরুতে মাহমুদ চৌধুরী এ সমস্যাগুলো নিয়েই কথা বললেন। তিনি বলেন, গরমের সময় সবচেয়ে বেশি যে সমস্যা দেখা দেয়, তা হলো ঘামাচি বা মিলিয়ারিয়া। সেই সঙ্গে বয়স্ক ও বাচ্চাদের ফোড়া বা সামার ব্রণ হয়। কিছু মানুষের সেবোরিক ডারমাটাইটিস নামের চর্মরোগ হয়ে থাকে। এটা গরমে প্রকোপ বেড়ে যায়। এ ছাড়া ঘামের দুর্গন্ধ হয়।
আর ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা দেয়। বিশেষ করে যাঁরা অতিরিক্ত মোটা, ডায়াবেটিস আছে, ঠিকমতো গোসল করতে পারেন না বা সারা দিন রান্নাঘরে কাজ করেন, তাঁদের এ সমস্যা বেশি দেখা দেয়। বর্ষা চলে এসেছে। এ সময়ে পায়ের যত্ন নেওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাইরে থেকে এসে পা ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। সব সময় শুকনা রাখতে হবে। যাদের ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে, তাদের এ কাজ অবশ্যই করতে হবে। এ সময়ে পায়ে ছত্রাক আক্রমণ করে। আর পায়ে ছোট ছোট ছিদ্র হয়ে থাকে।
ত্বকের এ সাধারণ সমস্যা থেকে বাঁচতে এ গরমে ঠান্ডা পরিবেশে থাকার চেষ্টা করতে হবে। বাইরে থেকে ঘরে ফিরে ভালোভাবে হাত-মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। সম্ভব হলে তোয়ালে ফ্রিজের ভেতর রেখে দিতে হবে। পরে সেটি দিয়ে হাত-মুখ মুছে ফেলা যাবে। যাঁদের ঘাম বেশি হয়, তাঁরা বাইরে যাওয়ার সময় পাউডার ব্যবহার করবেন। যাঁদের ডিহাইড্রেশন বেশি হয়, তাদের হাইপ্রেশারের সমস্যা না থাকলে স্যালাইন খেতে হবে।
কোভিডের কারণে আমাদের প্রতিদিন মাস্ক পরতে হচ্ছে। এখনকার এই গরম ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় অনেকক্ষণ টানা মাস্ক পরার জন্য অনেকের অ্যাকনি বা ব্রণের সমস্যা হচ্ছে। এ নিয়ে চিকিৎসক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, মাস্ক অনেক রকমের আছে। সার্জিক্যাল মাস্ক, কাপড়ের মাস্ক। কাপড়ের মাস্ক সুতি কাপড়ের হলে সেটা ত্বকের জন্য বেশ ভালো। কারণ, সুতি কাপড়ে অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হয় না বললেই চলে। কারও যদি সার্জিক্যাল মাস্কের ম্যাটেরিয়ালে অ্যালার্জি থাকে, তাহলে অ্যাকনি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই মুখ পরিষ্কার রাখাটা জরুরি, বিশেষ করে যাদের ত্বক তৈলাক্ত। এ ধরনের ত্বক যাঁদের আছে, তাঁদের এ সময়ে তৈলাক্ত খাবার কম খেতে হবে এবং সুতি মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। এতে অ্যাকনি প্রতিরোধ হবে।
অ্যাকনির সমস্যায় কমবেশি সবাই ভুগে থাকেন। কিশোর বয়সে এটি খুব সাধারণ সমস্যা। আবার ৩০–এর পর মহিলাদের কিছু অ্যাকনির সমস্যা দেখা দেয়। আর যাঁদের পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম আছে, তাঁদের এটি হয়ে থাকে। অ্যাকনির সমস্যায় চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত নির্দিষ্ট মেডিকেশনে থাকা লাগে। এর বাইরে মুখ পরিষ্কার রাখা এবং তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হয়। আর অবশ্যই ব্যায়াম করতে হবে। এতে পুরো শরীরে রক্তসঞ্চালন বাড়ে।
অ্যালার্জি আলোচনা হয়। খাবারে অ্যালার্জি খুব সাধারণ সমস্যা। এ নিয়ে মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সবার যে একই খাবারে অ্যালার্জি হবে, এমন কোনো কথা নেই। একেকজনের একেক খাবারে অ্যালার্জি হয়ে থাকে। এটি যার সমস্যা, তাকে বের করতে হবে। এরপর সেই অনুযায়ী খাবারগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। রক্তের কিছু নির্দিষ্ট টেস্ট আছে। সেগুলো করালেও কিছুটা বুঝতে পারা যায়, কোন খাবার খেলে অ্যালার্জি হতে পারে। অ্যালার্জি হলে দেখা যায়, ঠোঁট ফুলে যায়, হাতে–পায়ে বড় বড় চাকার মতো দেখা দেয়, অনেক চুলকানি হয়। এ অবস্থাকে মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় আর্টিকেরিয়া বলা হয়। এটি তিন কারণে হতে পারে। ইনফেকশন, খাবার ও বাইরের জিনিস (দূষণ বা কাপড়)। এ সমস্যা নিয়ে কোন চিকিৎসকের কাছে গেলে প্রথমেই রোগীর ইতিহাস জানা হয়। শরীরে কোনো ইনফেকশন আছে কি না, কী খাবার খাওয়ার পর এমন হয়েছে, কোনো মেডিসিন নিচ্ছে কি না, এগুলো জানতে চাওয়া হয়। এভাবে বোঝা যায়, কিসের জন্য অ্যালার্জির সমস্যা হচ্ছে।
কারও যদি কোনো কারণে হঠাৎ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দেয়, তখন প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে হিস্টাসিন, বিল্টিন বা বিলাস্টিন–জাতীয় ওষুধগুলো সেবন করা যেতে পারে, এমনটাই বললেন ডা. মাহমুদ চৌধুরী।
স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের জন্য ত্বকে সেলুলাইটিস নামের মারাত্বক রোগ হয়ে থাকে। এ ব্যাকটেরিয়া আমাদের ত্বকের ওপরেই থাকে। কাটাছেঁড়া হলে বা শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলে কোনোভাবে যদি এটা ত্বকের সর্বনিম্ন স্তর, অর্থাৎ সাবকিউটেনিয়াস টিস্যুতে সংক্রমণ সৃষ্টি করে, তাহলেই সেলুলাইটিস হয়ে থাকে। এটি খুবই মারাত্মক একটি অসুখ। এটি হলে আগে থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আরও জটিল অনেক সমস্যাই হতে পারে। এমনকি রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাই সেলুলাইটিস হলে দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে।
চিকিৎসক মাহমুদ চৌধুরীর কাছে সানস্ক্রিন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, সানস্ক্রিন ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির হাত থেকে রক্ষা করে। কিন্তু যে আলো আমরা দেখতে পাই, তা থেকে রক্ষা করতে পারে না। অর্থাৎ সানস্ক্রিন দিলে কালো হবে বা এমন কোনো কথা নেই। এটি বাইরে যাওয়ার ২০ মিনিট আগে ব্যবহার করতে হবে। প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর। বেশি ঘাম হলে এক ঘণ্টা পরপর।