দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ইউনিটারের অনুষ্ঠানে নেপাল ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের এলা অ্যাম্বাসেডর
দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত ইউনিটারের অনুষ্ঠানে নেপাল ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনের এলা অ্যাম্বাসেডর

তিন বছরে ‘এলা প্যাডে’র পথচলা

যাত্রার শুরুতেই সাড়া ফেলেছিল গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় থেকে তৈরি এলা প্যাড। এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিল অন্যরা। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি হাঁটি হাঁটি পা পা করে যে উদ্যোগের শুরু হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই দাঁড়িয়ে গেছে। সমাদৃত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে।

২৮ ও ২৯ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ আয়োজিত ‘সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস’ শিরোনামে অনলাইন কর্মশালায় সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিআরডি) এলা প্যাড নিয়ে তাদের গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করে। সেটির শিরোনাম ছিল ‘গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন: নারী গার্মেন্টসকর্মীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চয়তার পথে এক যাত্রা’। পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে, পোশাককর্মীদের বিনা খরচে মাসিককালীন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মাধ্যমে তাঁদের ক্ষমতায়িত করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়। উদ্যোগটি সেখানে উপস্থিত প্রধান অতিথি, বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সমাদৃত হয়। এলা প্যাডের উদ্যোক্তা মামুনুর রহমান। তিনি জাতিসংঘে দীর্ঘদিন জেন্ডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি জানালেন প্রায় দুই বছর দীর্ঘ মহামারিকালে এলা প্যাডের পথচলার কথা।

এলা প্যাডের সঙ্গে যুক্ত নারীদের একাংশ

পোশাকশিল্প কারখানায় পোশাক তৈরির পর সেই পোশাক তো দূরে থাক, যে ঝুট কাপড় নিচে পড়ে থাকে, সেটি ধরারও কোনো অধিকার রাখেন না কর্মীরা। কিন্তু ‘এলা’ প্রজেক্টের অধীনে ধীরে ধীরে খুব ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও বদলে যাচ্ছে সেই চিত্র। কারখানার কাটিং টেবিল থেকে ফেলে দেওয়া সেই কাপড় দিয়েই মামুনুর রহমানের উদ্যোগে পোশাককর্মীরা স্যানিটারি প্যাড বানানো শুরু করেন ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে। তিন বছরের পথচলায় পরিসরে, কলেবরে, নারীর ক্ষমতায়নে, দেশি–বিদেশি স্বীকৃতিতে সমৃদ্ধ হয়েছে এ উদ্যোগ।

মহামারিকালের শুরুতে ২০২০ সালের মার্চে ‘এলা প্যাড’ বুঝতে পেরেছিল যে সামনের দিনগুলোতে মাস্কের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। তারা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) সঙ্গী করে সারা দেশে গেঞ্জি (নিট) কাপড় দিয়ে মাস্ক বানায় এবং তা বিনা মূল্যে বিতরণ করে। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য মাস্কগুলো বানিয়েছে এলা অ্যালায়েন্সের সদস্য বেক্সিমকো, রেডিসন, পলমল গ্রুপসহ ১০টির বেশি পোশাক কারখানার কর্মীরা। এই উদ্যোগের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত নিম্নবিত্তদের মধ্যে প্রায় ২০ লাখ মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে।

মাস্ক তৈরি করছেন একজন কর্মী

মহামারিকালে দীর্ঘদিন গার্মেন্টস বন্ধ ছিল। তখন নারী পোশাককর্মীদের মফস্বলে চলেছে এলা প্যাডের কার্যক্রম। সেখানে ১২ থেকে ১৫ নারী মিলে তৈরি করেছে একেকটি দল। সেই দলকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে এলা প্যাড। নারায়ণগঞ্জ, ধামরাই, গাজীপুরের বিভিন্ন গার্মেন্টস থেকে জুট কাপড় সংগ্রহ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে তাঁরা নিজেরা নিজেদের কমিউনিটির জন্য প্যাড তৈরি করেছে। বিভিন্ন অঞ্চলে এ রকম নারীদের সংখ্যা তিন শতাধিক।

বর্তমানে ১৫টি গার্মেন্টসের সঙ্গে কাজ করছে এলা প্যাড। এসব গার্মেন্টসের নারী ও পুরুষ কর্মীরা কাজের অবসরে ওই গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় দিয়ে নিজেদের জন্য তৈরি করে প্যাড, মাস্ক। এভাবে একদিকে যেমন পিরিয়ড নিয়ে ট্যাবু দূর হচ্ছে, অন্যদিকে নারীদের জন্য পুরুষ পোশাককর্মীরা প্যাড বানানোর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে জেন্ডার সংবেদনশীলতা। যুক্তরাজ্যের ফুটপ্রিন্ট ম্যাগাজিনে স্থান করে নিয়েছে এ উদ্যোগ।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অ্যানথ্রোপলজির এক অধ্যাপককে উপহার দিচ্ছেন মামুনুর রহমান

এলা প্যাড এখন কেবল প্যাড আর মাস্কের ভেতর সীমাবদ্ধ নেই। ঝুট আর ঝুটের ঝুটও ব্যবহৃত হচ্ছে। সরবরাহকৃত গার্মেন্টস ঝুট থেকে এলা প্যাড তৈরির পর যে ঝুট থাকছে, তা দিয়ে এই নারী কর্মীরা নিজেদের এলাকায় কুশন, ব্যাগ, লুসনি, পাপোশ, জুতাসহ নানা কিছু বানাচ্ছে। এই নারীদের প্রশংসা ঝরে পড়ল মামুনুল হকের গলায়। তিনি বললেন, ‘আমাদের দেশের এই নারীরা কিন্তু খুব শৈল্পিক আর সৃজনশীল। ওরা ইউটিউবে দেখে দেখে নানা কিছু বানিয়ে ফেলে। নানা নকশা করে। কেবল শুরুটা করে দিলেই হয়। বাকিটা ওরা নিজেই বুঝে নিয়ে তরতর করে এগিয়ে যায়।’ এই উদ্যোক্তা আরও জানান, তিনি পোশাককর্মী স্বামী–স্ত্রী দুজনকে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় গিয়ে সেখানকার নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বলেন। বিনিময়ে তাঁদের ২ জনকে ২৫ হাজার করে ৫০ হাজার টাকা পারিশ্রমিক দেওয়ার কথাও বলেন। কিন্তু তাঁরা যেতে রাজি নন। তাঁরা নিজের গ্রামেই কাজ করে সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন।

ডিরেক্টর অব ইনস্টিটিউ অব ডেভেলপমেন্ট এবং ডিরেক্টর অব ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের সঙ্গে অ্যালামনাই চ্যাম্পিয়ন মামুনুর রহমান (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) ও রেজনি

এদিকে উখিয়ায়ও পৌঁছে গেছে এলা প্যাডের কার্যক্রম। সেখানে ৬০ ‘প্রতিবন্ধী’ রোহিঙ্গাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়অ হয়েছে। তাঁরা বানাচ্ছেন এলা প্যাড। তাঁদের উপযোগী যন্ত্র পাঠানো হয়েছে। এই উদ্যোগের সঙ্গী হয়েছে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম ও আইসিসিও। এ প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্কিলস ডেভেলপমেন্ট ফর পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস’।

এলা প্যাড এবার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করবে। গ্রামে দলগতভাবে নারীদের যেভাবে এলা প্যাডের কার্যক্রম চলছে, স্কুল কলেজগুলোতেও সেভাবে কার্যক্রম শুরু করার কথা ভাবছে এলা প্যাড। এ ছাড়া মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের প্রকল্প মা ও শিশুবিষয়ক কর্মসূচির সঙ্গেও কাজ কারার ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা চলছে।

ছবি: মামুনুর রহমানের কাছ থেকে সংগৃহীত

আরও পড়ুন: