দারুচিনি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে
দারুচিনি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে

দারুচিনি দ্বীপ নয়, দারুচিনির গুণের কথা

দারুচিনি অত্যন্ত সুস্বাদু মসলা। অসাধারণ স্বাদের জন্যই এর কদর বিশ্বব্যাপী। উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কিছু দেশে ঝালজাতীয় খাবারে এর ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে ইউরোপ ও আমেরিকায় বিভিন্ন মিষ্টি খাবারের স্বাদে ভিন্নমাত্রা আনতে দারুচিনির বেশি ব্যবহার দেখা যায়।

দারুচিনির একটি শাখা

আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর চাষ হচ্ছে। ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনে ওষুধ হিসেবে এর ব্যবহারে প্রমাণ পাওয়া যায়। দারুচিনি দিয়ে প্রাচীন মিসরে শ্বাসকষ্টের ওষুধ বানানো এবং মাংস সংরক্ষণ করা হতো। সপ্তদশ শতাব্দীতে দারুচিনি ডাচ্‌ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য সবচেয়ে লাভজনক মসলায় পরিণত হয় এবং এদের মাধ্যমে সারা বিশ্বের রান্নাঘরে আধিপত্য বিস্তার করে।

বেশ কয়েক রকমের দারুচিনি পাওয়া যায়। এর ভেতর সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ক্যাসিয়া ও সিলন দারুচিনি। ক্যাসিয়া দারুচিনি পশ্চিম এশিয়া আর আমেরিকা, ইউরোপে এবং সিলন দারুচিনি মেক্সিকো, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় চাষ হয়। এ ছাড়া আছে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ান দারুচিনি।

শুধু অনন্য স্বাদের জন্য নয়, দারুচিনি বিখ্যাত তার গুণাগুণের জন্যও। এতে রয়েছে এমন কিছু উপাদান, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

এতে আছে প্রচুর অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট

ফ্রি র‍্যাডিকেলের মাধ্যমে যে অক্সিডেটিভ ক্ষতি হয়, তার হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট। দারুচিনি পলিফেলনের মতো শক্তিশালী সব অ্যান্টি–অক্সিডেন্টে ভরপুর। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রায় ২৬টি মসলায় অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। এর ভেতর দারুচিনিতে অ্যান্টি–অক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি। এ জন্য একে ‘সুপার ফুড’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

দারুচিনি পলিফেলনের মতো শক্তিশালী সব অ্যান্টি–অক্সিডেন্টে ভরপুর

পরিপূর্ণ অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদানে

শরীরের জন্য ইনফ্ল্যামেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরের বিভিন্ন ইনফেকশনের বিরুদ্ধের লড়াই করে এবং নতুন করে কোষ গঠনে সাহায্য করে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ইনফ্ল্যামেশন শরীরের জন্য খুবই বিপজ্জনক। অনেক রোগের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী এটি। শরীরে এর ভারসাম্য বজায় রাখতে দারুচিনি খুব ভালো কাজ করতে পারে। কারণ এর অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট একই সঙ্গে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদানও বটে।

ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস ইনফেকশনের যম

দারুচিনির সুন্দর ঘ্রাণ আসে এর ভেতর থাকা ‘সিনামালডেহাইড’ নামের একটি বিশেষ তেল থেকে। এই পরামর্শ নেই অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিভাইরাল উপাদান। এ জন্য সর্দি–কাশি হলে চিকিৎসকেরা মাঝেমধ্যে দারুচিনি–চা খাওয়ার পরামর্শ দেন। ব্যাকটেরিয়াজনিত মুখের সংক্রমণ, দাঁতের ক্ষয় আর মুখের দুর্গন্ধ দূরে রাখতে বেশ উপকারী এটি।

দারুচিনির ফুল

রক্তে চিনি কমায়

একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, খাওয়াদাওয়া করার পর রক্তে যে গ্লুকোজ যোগ হয়, তার মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে দারুচিনি। হজমের সময় কার্বোহাইড্রেটের ভাঙনকে ধীর করে দেয়। অন্যদিকে, এর পলিফেলনে থাকা এমএইচসিপি নামের একটি যৌগ ইনসুলিনের মতো কাজ করে। কোনো কোনো গবেষণায় বলেছে, এই যৌগ ইনসুলিন ক্ষরণের মাত্রা বাড়ায়। এভাবে দারুচিনি টাইপ–টু ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়তা করে।

হৃদ্‌যন্ত্রের যত্ন নিতে

হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত রোগীদের ওপর করা একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যারা প্রতিদিন ১২০ মিলিগ্রাম পরিমাণ দারুচিনি খেয়েছেন, তাঁদের রক্তে এলডিএল (খারাপ) কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে, এইচডিএল (ভালো) কোলেস্টেরলের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কোলেস্টেরল যে হৃদ্‌যন্ত্রের কতটা ক্ষতি করে, সেটা এখন কমবেশি সবাই মোটামুটি জানে।

স্মৃতিশক্তিজনিত রোগ প্রতিরোধে

দারুচিনি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এর অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট আলঝেইমার ও পারকিনসন রোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।

দারুচিনি রক্তের চিনির মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমিয়ে দিতে পারে। তাই প্রাপ্তবয়স্কদের দিনে এক চা–চামচের বেশি দারুচিনি খাওয়া ঠিক নয়। শিশুদের ক্ষেত্রে মাত্রাটি আরও কম।

আর্থ্রাইটিসের ব্যথা কমাতে

এতে আছে প্রচুর ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামের মতো খনিজ উপাদান। এই উপাদানগুলোর জন্যই দারুচিনি আর্থ্রাইটিসের ব্যথা কমাতে বেশ কার্যকর। পশ্চিমের অনেক দেশেই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় দারুচিনির সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়।

সতর্কতা

অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। সে যত উপকারী জিনিসই হোক না কেন। দারুচিনির ক্ষেত্রেও ঠিক তা–ই। এটি অবশ্যই সীমিত পরিমাণে খেতে হবে। অনেকে ওজন কমানোর জন্য সকাল–বিকেল দারুচিনির–চা পান করেন। আবার রান্নাতেও ব্যবহার করছেন। এর এ রকম অবাধ ব্যবহারে একটু লাগাম টানতেই হবে। কারণ, অতিরিক্ত দারুচিনি যকৃতের ক্ষতি করতে পারে। রক্তের চিনির মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমিয়ে দিতে পারে। তাই প্রাপ্তবয়স্কদের দিনে এক চা–চামচের বেশি দারুচিনি খাওয়া ঠিক নয়। শিশুদের ক্ষেত্রে মাত্রাটি আরও কম।

তথ্যসূত্র: হেলথ লাইন, মাস্টারক্লাস, বিবিসি গুড ফুড, নিউ সায়েন্টিস, এভরিডে হেলথ, স্টাইলক্রেজ।