প্রত্যেক সফল মানুষের জীবনের গল্পে কমবেশি অবদান রয়েছে ডাক্তারদের। কিন্তু সেই ডাক্তারদের জীবনের গল্প থেকে যায় আড়ালেই। এসকেএফের নয়া আয়োজন ‘সফল মানুষের গল্প’-এ যুক্ত হয়েছে প্রথম আলো। এখানে শোনা যাবে ডাক্তারদের জীবনকথা।
ডাক্তারদের জীবন নানা ঘটনায় সাজানো ‘সফল জীবনের গল্প’র প্রথম পর্বে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফি মজুমদার। তিনি বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটির মহাসচিব ও জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন ডা. নাযমুস সাকিব।
সফল ডাক্তার অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফির জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকা কলেজ আর ঢাকা মেডিকেল কলেজে। জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে করেছেন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন। ছোটবেলা থেকেই সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফি ১৯৮২ সালে ঢাকা মেডিকেল থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সালে ডিপ্লোমা ইন কার্ডিওলজি কোর্সে ভর্তি হন। সেটিই ছিল প্রথম ব্যাচ। পাঁচজন বাংলাদেশি ও একজন নেপালি ছাত্র নিয়ে শুরু হয় সেই কোর্স। ডিপ্লোমা শেষ করে ১৯৮৬ সালে তিনি এমডি কার্ডিওলজিতে ভর্তি হন। এটা বাংলাদেশে কার্ডিওলজির সর্বোচ্চ ডিগ্রি। পরে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) থেকে তাঁকে ২০১৭ সম্মানজনক এফসিপিএস মেডিসিন ডিগ্রি প্রদান করে।
এ ছাড়া তিনি আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি, ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজি, আমেরিকান সোসাইটি অব ইকো কার্ডিওগ্রাফি, কার্ডিওলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার ফেলোশিপ আছে। এ ছাড়া ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। সেটা এই ডাক্তারের জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক ঘটনা ছিল। কেননা, বাংলাদেশের কোনো ডাক্তার এর আগে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ফেলোশিপ পাননি।
১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন আবদুল্লাহ আল সাফি। ১৯৯৩ সালে তিনি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদে নিযুক্ত হন। এই ছয় বছর তিনি ঢাকা মেডিকেলে ছিলেন। ১৯৯৬ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক (কার্ডিওলজিস্ট) হিসেবে যোগদান করেন। ওখানে তিনি ২০০২ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। ২০০৪ সালে তিনি জাতীয় বাতজ্বর ও হৃদ্রোগ কেন্দ্রের (জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের পাশে) পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপকের কাজও চলছিল। এরপর ২০১৫ সাল পর্যন্ত সেটা চলে। ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
* কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো
* অন্তত ৪০টি আন্তর্জাতিক ফোরামে যোগদান। এর ভেতর আমেরিকান ফোরাম অব কার্ডিওলজির বার্ষিক ফোরামে আমন্ত্রিত হন তিনি।
* তাইওয়ান, চায়না কার্ডিয়াক সোসাইটিতে অংশগ্রহণ
* ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল কর্তৃক সম্মানিত হন
অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফি স্মৃতিচারণায় বলেছেন, সময়ের সঙ্গে পার্থক্য তো থাকবেই। আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, তখন ইন্টারনেট ছিল না। আমরা বিভিন্ন লাইব্রেরি ঘুরে ঘুরে পড়াশোনা করতাম।। মনে আছে, থিসিস পেপার জমা দিতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। তবে ওটাকে কষ্ট মনে হয়নি। ফটোকপি করাও কষ্ট ছিল। তাই আমরা খুব বাছাই করে করে ফটোকপি করতাম। এই জার্নালের এইটা, আর কোনটা না...এ রকম। তবে সেই কষ্ট করে অর্জিত জ্ঞানের বোধ হয় একটা আলাদা মূল্য আছে। দিনের পর দিন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতাম।
এখন তো সব হাতের মুঠোয়। এখন বিদ্যা সহজ হয়ে যাওয়ায় অনেকে এর মূল্যায়ন কম করে। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সময় থেকে এখন বেশি ভালো ডাক্তার তৈরি হচ্ছে। কেননা, চিকিৎসাক্ষেত্রে নতুন নলেজ হয়েছে। আমি সব সময়ই চাই, আমার ছাত্র আর সন্তানেরা আমাকে ছাড়িয়ে যাক।
অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফির প্রিয় খাবার খুবই স্বাস্থ্যসম্মত। ভর্তা, ছোট মাছের চচ্চড়ি, ডাল এগুলোই। তিনি বলেন, কখনোই বিরিয়ানি বা রিচ ফুড টানে না। মাছ, ভাত, ডালই আমার প্রিয়। আমি সব সময় বলি, বাঙালির খাবার খেলে হৃদ্রোগ হবে না।
অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফি বলেছেন, আমার বাবা ছিলেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য। ওনাকে আইয়ুব খানের শাসনামলে অসময়েই রিটায়ারমেন্টে দিয়ে দেয়। উনি অতিরিক্ত সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে রিটায়ার করেছিলেন। ওনার কাছ থেকে আমরা সব ভাইবোন যেটা পেয়েছি, সেটা হলো অনমনীয়তা। প্রিন্সিপাল কখনোই কম্প্রোমাইজ করতেন না। আমার পরিচিত অনেকেই বলেন যে উনি ছিলেন দরবেশ মানুষ। উনি খুবই সৎ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। উনি কোনো দিন জি হুজুরগিরি করেননি। তার খেসারতও দিতে হয়েছিল। আমার দাদার পরিচয়টাও দিয়ে দিই। আমার দাদা ছিলেন শিক্ষক। উনি চাইতেন যে আমার বাবা শিক্ষক হোক।
যদিও তখন জজ–ব্যারিস্টার হওয়া আরও বড় ব্যাপার ছিল। তবু আমার দাদা চাইতেন যে আমার বাবা যেন শিক্ষক হন। এটা মনে করে আমার খুব গর্ব হয়। আমি খুব খুশি যে বাবা না হলেও আমি শিক্ষক হতে পেরেছি। আমার দাদার ছাত্র ছিলেন মো. নাসির উদ্দিন, সওগাত পত্রিকার সম্পাদক। তাঁদের বসবাস ছিল চাঁদপুর। এখন জেলা হয়েছে। তখন ছিল মহকুমা। আমার মা গৃহিণী ছিলেন। উনি কলকাতার রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে পড়াশোনা করেন। আমার নানাও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। আবগারি শুল্ক বিভাগের কমিশনার হিসেবে উনি কলকাতায় ছিলেন। নূরজাহান বেগম ছিলেন তাঁর সহপাঠী। আমার মা–বাবা দুজনেই খুবই এনলাইটেনড। বিনয়ী, কিন্তু মেরুদণ্ড সোজা রাখতেন সব সময়।
অবসর পাই কই? এখন অবশ্য একটু পাই। আমি বইপাগল। আমি অবসরে বই পড়ি। আর বই সংগ্রহে রাখি। আমি এখন যে বাসায় থাকি, এখানে সাধারণত কাউকে দাওয়াত দিই না। কারণ, সারা বাড়ি এলোমেলোভাবে বই দিয়ে ছড়ানো–ছিটানো। গোছালেও আবার দুদিন পর যা তাই! আমার স্ত্রী সহ্য করে থাকেন আরকি। আমি খুব কষ্ট করে শুই। কারণ, আমার চারপাশে এত বই...ঘরে, বারান্দায়, বাথরুমে, ডাইনিংয়ে। কিনব না কিনব না করে আবার কেনা হয়। বই যাঁরা সংগ্রহ করে, তাঁরা প্রথম সংস্করণ কেনে, আবার সেই বইয়ের পরের সংস্করণগুলোও কেনে। প্রচ্ছদটা হয়তো ভালো লাগে। না হলে মনে খুঁতখুঁত করে। আমার বই রাখার জায়গা নেই। আমার নিজেকে রাখারই জায়গা নেই। তবু বই কেনা বন্ধ হয় না। আরও একসময় শখ ছিল, গানের সিডি সংগ্রহের। তারপর স্ট্যাম্প কালেকশন করি। তারপর বিভিন্ন দেশের কারেন্সি নোটও সংগ্রহ করি। খেলা বুঝিও না, দেখিও না। সিনেমা দেখছি সারা জীবনে হাতে গোনা কয়েকটা। তাই আমার সময় থাকে হাতে।
যেটুকু সময় বাঁচে, বই পড়ি। আগে স্কুল, কলেজে থাকতে নিয়মিত ইত্তেফাকে লিখতাম। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই আমার মেন্টর হিসেবে ছিলেন। মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর আর সময় পাইনি। তবে প্রফেশনাল বই আছে। কিছু বই সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছি। তা ছাড়া আমি একটু আড্ডা দিতে পছন্দ করি। আমি নিজের চেয়ে বয়সে, কর্মে বড় মানুষদের সঙ্গে আড্ডা দিই। অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতাম। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম সে রকম আরেকজন। এখন অবশ্য আমার আড্ডার লোক নেই বললেই চলে। আড্ডা নিয়ে মানে কোনো একটা বিষয় বা সমস্যা নিয়ে আড্ডা। এই আড্ডাটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেবল আড্ডা দিতে আমি বিদেশেও যাই।
আমি মূলত আগেকার লেখকদের বই পড়ি। শরৎচন্দ্র, ডিটেকটিভ বই, দীনেন্দ্রনাথ রায়ের সিরিজ, শশধর দত্তের দস্যু মোহন সিরিজ তো আমি গোগ্রাসে গিলেছি। আমি সকালে উঠে কোরআন শরিফ পড়তাম। তারপর আবার গীতাঞ্জলি বের করে দু–একটা কবিতা মুখস্থ করার চেষ্টা করতাম। এখনো আমার অনেক কবিতা মুখস্থ। হুমায়ূন আহমেদের লেখার স্টাইল লুসিড, পড়তে ভালো লাগে। ইতিহাসের বই আমার প্রিয়। ইদানীং মুনতাসীর মামুন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, হারুন অর রশীদদের বই পড়ি। তাঁদের ফোকাল পয়েন্টগুলো আগ্রহ জাগায়।
আমার ইতিহাসের বইয়ের একটা ভালো কালেকশন আছে। তবে ট্র্যাডিশনাল লেখকদের বই ওভাবে পড়া হয়নি। বনফুল পড়েছি। সৈয়দ মুজতবা আলী আমার ভীষণ প্রিয়। আমার মনে হয় আমাকে যদি ওনার সমগ্র দিয়ে জেলখানায় পাঠিয়ে দেওয়া যায়, আমি দুই–তিন বছর দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারব। উনি এমন লেখক, যার লেখা বারবার পড়া যায়।
আমার কাছে কিন্তু আমার জীবন সফল মনে হয় না। মনে হয়, আমি হয়তো আরও অনেক কিছু করতে পারতাম। পারিনি। নতুন প্রজন্মের ডাক্তারদের বলব, জ্ঞানের সঙ্গে কমিটমেন্টটাও বড্ড জরুরি। সৎ থাকা জরুরি। ‘নেক্সট গড’ হিসেবে আমাদের সম্মান দেওয়া হয়। সেটি ইদানীং অনেকটা কমে গেছে। এ জন্য একপাক্ষিকভাবে দোষ না দিয়ে আমাদের বোধ হয় একটু সেলফ ক্রিটিসাইজ করার সময় চলে এসেছে। নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব। সমাজে অনেক সফল মানুষ আছে, সেই সফলতার সঙ্গে মর্যাদাটা রক্ষা করাও জরুরি।