Thank you for trying Sticky AMP!!

'হৃদয়ের শত্রু'র বিরুদ্ধে অস্ত্র বানান সাইকেলকে

সাইকেল চালাতে পারে এমন একজনের সাহায্য নিলে দ্রুত শিখে যাবেন দুই চাকার বাহনটি চালানো। ছবি: প্রথম আলো

দুই বছর আগে ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিশ্বে প্রতিবছর সব অকালমৃত্যুর প্রতি ১০টির মধ্যে একটি হয় ব্যায়াম না করার কারণে। মানে, নিয়মিত শরীরচর্চায় সুস্থ জীবন ও দীর্ঘায়ু হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

কিন্তু এই কর্মব্যস্ত জীবনে শরীরচর্চার জন্য আলাদা করে সময় বের করা অনেকের কাছেই বিলাসিতা। তা ছাড়া শরীরচর্চা নিয়ে বাঙালির দর্শনও একটু আলাদা। বাঙালির শরীরচর্চা মানে রোজ সকালে একটু হালকা ব্যায়াম আর দৌড়।
আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, টোটকা আছে। সেটা দৌড়ের চেয়েও ভালো! সাইক্লিং। সহজ কথায়, সাইকেল চালানো। তরুণ প্রজন্মের বিশেষ পছন্দের বাহন। পরিবেশবান্ধব এবং জ্যামের মধ্যে সর্পিল গতিতে এঁকেবেঁকে যাওয়ার সুবিধায় সাইক্লিংয়ের জনপ্রিয়তা দিনে দিনে ঊর্ধ্বমুখী।
বিশেষ করে ঢাকার রাস্তায় এখন প্রচুর সাইকেল। অফিসে যাতায়াতের জন্যও বাড়ছে সাইকেলের ব্যবহার। এদের শরীরচর্চার জন্য আর আলাদা করে সময় বের করার হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে না। শরীরচর্চা হচ্ছে, তেমনি ঢাকা শহরটাকে দূষণের হাত থেকেও কিছুটা বাঁচানো যাচ্ছে আর জ্বালানি খরচ না থাকায় পকেটের পয়সাও বাঁচছে।
তবে ক্যালরি পুড়ছে। শরীর থেকে ঝরছে অতিরিক্ত মেদ। শুধু নিয়মিত ‘সাইক্লিং’ করেই ছিপছিপে ফিট জীবনের স্বাদ পাচ্ছে বাঙালি। গবেষণাও বলছে, শরীরচর্চায় ‘সাইক্লিং’য়ের জুড়ি মেলা ভার। আসুন জেনে নেই সাইক্লিংয়ের উপকারিতা:

ফিটনেস বান্ধব
সাইকেল চালালে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে হৃৎপিণ্ড ভালো থাকে। উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও ‘সাইক্লিং’ ভীষণ উপকারী। স্পোর্টস জার্নাল মেডিসিন অ্যান্ড সায়েন্স-এর গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, শরীরচর্চায় দৌড়ানোর চেয়েও বেশি ভালো সাইক্লিং ও সাঁতার। শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে চাইলে সাইকেল চালাতে পারেন। ঘণ্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার গতিতে সাইকেল চালালে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ ক্যালরি খরচ হয়। আর্কাইভ অব পেডিয়াট্রিকস অ্যান্ড অ্যাডলোসেন্ট মেডিসিন সাময়িকী জানিয়েছে, নিয়মিত সাইকেল চালালে মোটা লোকদের স্বাভাবিক ওজন ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ৮৫ শতাংশ। একই সাময়িকীতে প্রকাশ, যাঁরা কর্মক্ষেত্রে রোজ সাইকেল চালিয়ে যান, তাঁদের মোটা হওয়ার আশঙ্কা মাত্র ৪০ শতাংশ।
শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝড়াতে তাই ‘সাইক্লিং’ হতে পারে খুব ভালো উপায়। সাইকেল চালালে শরীরের সমস্ত অংশের ওপর প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে কোমর থেকে শরীরের নিম্নাংশ পর্যন্ত সব ধরনের পেশির সংকোচন-প্রসারণ ঘটে। এতে পেশি সুগঠিত হয়। সাইকেল চালালে প্রচুর ঘাম নিঃসরণ হয়। রক্তে নিঃসরণ হয় ভালো লাগার হরমোন এন্ডোরফিন। মনে প্রশান্তি আসে, মন ভালো থাকে এবং অতিরিক্ত চাপ কমায়।

সাইকেল হয়ে উঠতে পারে আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধুও। ছবি: প্রথম আলো

হৃৎপিণ্ড ভালো রাখে
যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা পাঁচ বছর ধরে গবেষণার পর জানিয়েছেন, যেসব মানুষ নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে কর্মক্ষেত্রে যান, তাঁদের হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৪৬ শতাংশ কমে যায়। ভারতের শ্রী বালাজি অ্যাকশন মেডিকেল ইনস্টিটিউটের ‘ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট’ অমর সিঙ্গলের ভাষ্যও একই রকম। তাঁর মতে, প্রতিদিন ন্যূনতম ২০ মিনিট সাইকেল চালালে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় অর্ধেক কমে যায়।
কোপেনহেগেন ‘হার্ট স্টাডি’র গবেষকেরা প্রায় ১৪ বছর ধরে ৫ হাজার মানুষের ওপর গবেষণা করেছেন। তাঁদের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, তীব্র ‘সাইক্লিং’ মানুষের হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে রক্ত জমাট বাঁধতে বাধাগ্রস্ত করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ২৭ শতাংশ মৃত্যুর কারণ হলো করোনারি (হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী ধমনি) হৃদ্‌রোগ। দেশীয় চিকিৎসকদের মতে, বাংলাদেশে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। এর মধ্যে শিশু-কিশোরদের হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়ছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি সপ্তাহে ন্যূনতম ১৫০ মিনিট তীব্র শরীরচর্চা করলে ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়। প্রতিদিন গড়ে ২০-২৫ মিনিট ‘সাইক্লিং’ কিন্তু এ কাজটা করে দিতে পারে।

যানজটে উপযোগিতা
গত জুলাইয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের গবেষণা থেকে জানানো হয়, ঢাকায় শুধু যানজটের কারণে প্রতিবছর ক্ষতি হয় অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা এখন কোনোমতেই ঘণ্টায় গড়ে সাত কিলোমিটারের বেশি গতি পায় না যন্ত্রচালিত যানবাহন। জাইকার সঙ্গে পরিচালিত এক সরকারি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকায় শুধু যানজটের কারণে দৈনিক সময় অপচয় হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা।
যানজটের কারণে অপচয়িত সময়ের মূল্য বের করা কঠিন। তা ছাড়া সবার সময়ের মূল্যও এক রকম নয়। যেমন ধরুন ছাত্র, কর্মজীবী, ব্যবসায়ী কিংবা অন্য কোনো পেশার মানুষের কর্মঘণ্টার মূল্য সমমানের হবে না। এতসব তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের কারণ হলো, ঢাকার অসহ্য যানজট এড়ানোর সেরা বাহন হয়ে উঠতে পারে সাইকেল! ধরা যাক, আপনি মিরপুর থেকে মতিঝিলে যাবেন। সাধারণ যানজটে বাসে উঠলে পৌঁছাতে লাগবে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। আর ‘অসাধারণ’ কিংবা গাড়ির চাকা নড়ে না এমন যানজট হলে তো কথাই নেই, কখন পৌঁছাবেন জানেন না! কথাটা কিন্তু শুধু বাসযাত্রী নয়, প্রাইভেট কার, সিএনজি কিংবা যেকোনো যন্ত্রচালিত যানবাহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সাইকেল কিন্তু সেখানে আপনাকে মিরপুর থেকে মতিঝিলে পৌঁছে দেবে ৪০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টার মধ্যে। সেটা যত বড় যানজটই হোক না কেন। সাইকেলের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, যানজটের মধ্যেই আপনি এঁকেবেঁকে সর্পিল গতিতে এগিয়ে যেতে পারবেন। ঢাকার মানুষ সাইকেলের এই উপযোগিতাটা বুঝতে পারছে বলেই ধীরে ধীরে সাইকেল আরোহীর সংখ্যা বাড়ছে।

তারুণ্যের ফ্যাশন
তরুণ-তরুণীদের ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গ এখন সাইকেল। একটি ভালো সাইকেল আপনার ব্যক্তিত্ব পাল্টে দিতে পারে। গ্লাভস, হেলমেট, বাইকিং টি-শার্ট, সানগ্লাস, জুতা, পানির বোতল নিয়ে আপনি যখন সাইকেলে চড়বেন, তখন সাইকেল চালানোর সেকেলে ধারণাটাই পাল্টে যায়। আপনি সেই সাইকেলই চালাচ্ছেন, কিন্তু নতুন আঙ্গিকে, নতুন রূপে। শুধু সাইকেলের কারণে তরুণ-তরুণীরা এখন আরও বেশি সংগঠিত। ‘সাইক্লিস্ট’দের কিছু গ্রুপ রয়েছে বাংলাদেশে, যারা মাঝেমধ্যেই রোমাঞ্চকর অনেক সফরে বেরিয়ে পড়ে। এতে তরুণ-তরুণীদের বিপথগামী হওয়ার হারও কমছে।

শেষ কথা
পৃথিবীতে ‘সাইকেলের দেশ’ নামে একটা জায়গা আছে, সেটা নেদারল্যান্ডস। দেশটির শহর রটারডামে বেশির ভাগ কর্মজীবীই সাইকেল চালিয়ে অফিসে যান। সব মিলিয়ে ডাচদের ৯০ শতাংশই সাইকেল চালিয়ে থাকে। শুধু ডাচরা নয়, ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, জাপান, সুইজারল্যান্ড ও চীনে সাইকেল ভীষণ জনপ্রিয় বাহন।
এসব উন্নত দেশের মানুষ যদি সাইকেল চালাতে পারে, তাহলে আমাদের কী সমস্যা? এ দেশের তরুণ-তরুণীরা সমস্যা মনে করে না বলেই সাইকেলের ব্যবহার দিনে দিনে ঊর্ধ্বমুখী। সংখ্যাটা আরও বাড়বে। কারণ, যানজট আর ফ্যাশন ছাড়াও শুধু শারীরিক সুস্থতার জন্য সাইকেল আরও কাছে টানবে বাঙালিকে।