ক্যানসার এমন এক রোগ, যার নাম শুনলে এখনো আঁতকে ওঠে মানুষ। শারীরিক কষ্ট, আর্থিক ধাক্কা, মৃত্যুভয়—সব মিলিয়ে ক্যানসার আজও মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। অথচ সেই ক্যানসারকে হারিয়ে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তেমনই এক লড়াকু নারী আরজিনা খাতুন। চিকিৎসা সম্পন্ন করার তিন বছর পর প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য মনের দুয়ার খুলে দিলেন তিনি। বিশ্বজুড়ে আজ পালিত হচ্ছে রক্তের ক্যানসার দিবস। এমন দিনে শুনুন রক্তের ক্যানসার জয় করে ফেরা আরজিনার গল্প।
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার চাকন্দ গ্রামের মেয়ে আরজিনা। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকায় এসে মিরপুরের গ্রামীণ ক্যালেডোনিয়ান কলেজ অব নার্সিং থেকে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি করেন তিনি। এরপর কাজ শুরু করেন আজগর আলী হাসপাতালের নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (এনআইসিইউ)। ওই বছর তাঁর বিয়েও হয়। পরের বছর সরকারি চাকরিতে ঢোকার সুযোগ পান। সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে পদায়ন হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও কাজের সুযোগ হয় এনআইসিইউতে। জীবন চলছিল চমৎকার ছন্দে, হাসি-আনন্দে।
২০২০ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে হঠাৎ খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। খাবার খেতে গেলেই গলা আর চোয়ালে ব্যথা হচ্ছিল। মাঝরাতের পর জ্বর। দাঁত ব্রাশ করার সময় রক্তও পড়ছিল। দুর্বল শরীর নিয়েও হাসপাতালে অসুস্থ নবজাতকদের সেবাদান চলতে থাকে। ১৫ থেকে ২০ দিনের মাথায় কর্মস্থলেই সহকর্মী সুলতানা পারভীন হঠাৎ খেয়াল করলেন, আরজিনার হাত দুটি ভীষণ ফ্যাকাশে। সুলতানা পারভীনই প্রথম ধারণা করলেন, রক্তশূন্যতায় ভুগছেন আরজিনা। সাদামাটা লক্ষণগুলোকে গুরুত্ব দিতে বললেন সুলতানা।
আরজিনা ভাবছিলেন দাঁতের সমস্যা থেকেই হয়তো এত সব ঝামেলা। তাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দন্ত বিভাগে গেলেন। চিকিৎসকেরা কিন্তু দাঁতে কোনো সমস্যা পেলেন না। বরং রক্তশূন্যতা দেখে মেডিসিন বিভাগে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। সেখানে রক্ত পরীক্ষা করা হলো। দেখা গেল, চারে নেমে গেছে হিমোগ্লোবিন! স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। কমেছে অণুচক্রিকাও। অন্যদিকে শ্বেতরক্তকণিকার মাত্রা অস্বাভাবিক রকম বেশি। মোটামুটিভাবে বোঝা গেল, ব্লাড ক্যানসার। জীবনে সেই প্রথম বড়সড় ধাক্কা।
সেটা ছিল ২০২০ সালের আগস্ট মাস। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের বিশেষায়িত সেবা নিশ্চিত করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অন্যান্য কিছু চিকিৎসাসেবা সাময়িকভাবে বন্ধ। তাই আরজিনাকে যেতে হলো মিটফোর্ড হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোগের ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন সেখানকার বিশেষজ্ঞরা। শুরু হলো চিকিৎসা। দেড় মাসে আরজিনাকে ৩৫ ব্যাগ রক্ত নিতে হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছে টানা চার মাস। পুরোটা সময় আরজিনাকে সেবা দিয়েছেন স্বামী নাহিদ হোসেন, মা এবং ভাতিজি অন্তরা। অন্তরা তখন ক্লাস এইটের শিক্ষার্থী। একমাত্র ফুফুর জন্য প্রাণ উজাড় করে দিয়েছিল মেয়েটি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কেমোথেরাপি নিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৪৬টি ইনজেকশন, ১ হাজার ২০০ ট্যাবলেট। পুরো চিকিৎসা ঠিকভাবে শেষ করাটা ধৈর্যের এক বিশাল পরীক্ষা ছিল। এত এত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও তো কম নয়! তবে আশার আলো ছিল আরজিনার মনের কোণে, আর স্রষ্টার প্রতি ছিল অগাধ ভরসা।
গ্রামবাংলার এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে আরজিনা। স্বামী পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তখন কর্মক্ষেত্রে নতুন। সঞ্চয় বলতে কারোরই খুব বেশি কিছু নেই। কঠিন সেই সময়টায় আরজিনার পরিবার, সহকর্মী সবাই যথাসাধ্য করেছেন। আর্থিক সহায়তা তো বটেই, মনের শক্তি ধরে রাখতেও সাহায্য করেছেন সব সময়। নার্সিং কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবেও আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন, এমনকি তাঁর কথা জানতে পেরে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও তাঁকে সাহায্য করেন। সেই সময় মিটফোর্ড হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম এবং সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামানসহ সব চিকিৎসক এবং নার্সের আন্তরিকতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করলেন আরজিনা। সেবার ব্রত নিয়েই তো নার্সিং পেশায় এসেছিলেন আরজিনা। তাঁর চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর অধ্যাপক ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম তাঁর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘তুমি নতুন জীবন পেয়েছ। প্রতিজ্ঞা করো, জীবনের শেষ পর্যন্ত মানুষের সেবা করবা।’ শ্রদ্ধেয় চিকিৎসকের সেই কথা অন্তরে ধারণ করেন আরজিনা। মানবসেবায় নিজেকে তিনি নিয়োজিত রাখতে চান আজীবন।
আরজিনা খাতুন বললেন, ‘নিজে রোগী হলেও পরিবারের সবার সামনে মনের জোর ধরে রাখতে হয়েছে সব সময়। তবে কখনো কখনো আমারও মনে হতো, হয়তো লড়াইটা হেরে যাব। আমার মৃত্যু হলে সমাজের চাপে ভালোবাসার মানুষটা হয়তো অন্য কারও হয়ে যাবে, এই আশঙ্কাও কাজ করত। কিন্তু মুখ ফুটে কোনো দিন বলতে পারিনি তাকে সেই ভালোবাসার কথা। অবশ্য আমার না বলা কথা সে ঠিকই অনুভব করত।’
নাহিদ যে আরজিনার না বলা কথাও বোঝেন, তার প্রমাণ কী? ক্যানসারের চিকিৎসার সময় নাহিদ একদিন নিজে থেকেই বলেছিলেন, ‘যা-ই ঘটুক না কেন, আমি তোমার ছিলাম, তোমারই থাকব।’ ভালোবাসার মায়ায় সত্যিই পূর্ণ হয়েছে আরজিনার জীবন। ক্যানসারের চিকিৎসা শেষে ফিরেছেন কাজে, হয়েছেন মা। এখন কাজ করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে। সন্তানের ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘এই আমার রূপকথার রাজকন্যা।’
সত্যিই তো, আরজিনার জীবনটাই তো একটা রূপকথা।