গর্ভাবস্থায় মায়ের দেহে হরমোনের কারণে মেটাবলিজম বা বিপাকপ্রক্রিয়া, হৃদ্যন্ত্র ও রক্ত সঞ্চালন এবং রোগ প্রতিরোধবিষয়ক প্রচুর পরিবর্তন দেখা দেয়। হরমোনের মধ্যে ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরনসহ নানাবিধ হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দেহে জলীয় অংশসহ রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে দেহের বিভিন্ন অংশে যেমন পরিবর্তন আসে, তেমনি চোখেও এর প্রভাব পড়ে। এই পরিবর্তনের অনেকগুলোই নির্দোষ এবং প্রসবের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যায়। কোনো কোনো বিষয়ে হয়তো সাময়িক কোনো ব্যবস্থা নিতে হতে পারে। তবে কিছু কিছু পরিবর্তন আছে, যেগুলো চোখের জন্য বেশ ক্ষতিকর।
দেহে জলীয় অংশের পরিমাণ বেড়ে গেলে চোখের কর্নিয়াতেও পরিবর্তন আসে। কর্নিয়া হলো চোখের সামনের কালো অংশ, যা লেন্স হিসেবে কাজ করে। কর্নিয়াতে অধিকতর তরল সংযোজিত হওয়ায় এর পুরুত্ব ও বক্রতা বেড়ে যায়। ফলে রিফ্রেকশনে পরিবর্তন দেখা দেয়, অর্থাৎ দৃষ্টির সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত মায়োপিয়া হতে দেখা যায়। প্রসবের পর এটি নিজ থেকেই সেরে যায়। প্রয়োজনে সাময়িক চশমা পরার প্রয়োজন হতে পারে।
ইস্ট্রোজেন ও প্রোলেক্টিন বেড়ে যাওয়ায় চোখের পানি বা টিয়ার প্রোডাকশন কমে যায়। ফলে ড্রাই আই বা শুষ্ক চোখের সমস্যা দেখা দেয়। চোখে খচখচ বা লালচে ভাব, জ্বালাপোড়া হতে পারে। এমনটি হলে আর্টিফিশিয়াল টিয়ার বা ড্রপ ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে।
গর্ভাবস্থার আগে যাঁদের ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ছিল, গর্ভাবস্থায় হরমোনের প্রভাবে তাঁদের রেটিনোপ্যাথি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এর প্রভাবে চোখে রক্তক্ষরণ হয়ে স্থায়ী অন্ধত্বের পরিণতি ডেকে আনতে পারে। গর্ভাবস্থায় খুব দ্রুত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। যাঁদের ডায়াবেটিসজনিত চোখের সমস্যা বা রেটিনোপ্যাথি আছে, তাঁদের গর্ভধারণের আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রয়োজনে চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শক্রমে চিকিৎসা নিতে হবে। ডায়াবেটিস গর্ভাবস্থার আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপজনিত চোখের সমস্যা বা হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি যাঁদের আছে, তাঁরাও অন্ধত্বের ঝুঁকিতে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও একই রকম সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন হরমোনের প্রভাবে, বিশেষ করে কর্টিসোল ও কেটাকোলামাইনের প্রভাবে চোখের রেটিনাতে অতিরিক্ত তরল জমা হয়, যাকে বলা হয় সেন্ট্রাল সেরাস কোরিও রেটিনোপ্যাথি। এতে দৃষ্টির সমস্যা দেখা দেয়। সময়মতো চিকিৎসা না হলে স্থায়ী দৃষ্টি-ঘাটতি হতে পারে।
যাঁদের গ্লুকোমা আছে, তাঁরা গ্লুকোমা বা চোখের উচ্চ চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের ড্রপ ব্যবহার করে থাকেন। গর্ভাবস্থায় বিটা ব্লকার, প্রোস্টাগ্লেন্ডিন অ্যানালগ ও আলফা-২–জাতীয় অ্যান্টিগ্লুকোমা ড্রপ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এসব ড্রপ ব্যবহারে মাতৃগর্ভে শিশুর হৃৎস্পন্দন বা হার্ট রেট কমে যায় এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।
গর্ভাবস্থায় যদি হঠাৎ দৃষ্টি কমে যায় বা চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, তবে বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মো. ছায়েদুল হক: চক্ষুবিশেষজ্ঞ ও সার্জন, ভাইস প্রিন্সিপাল, মার্কস মেডিকেল কলেজ, মিরপুর-১৪, ঢাকা