কম নাকি বেশি ঘুম হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়?

ভালো ঘুম শুধু বিশ্রামের জন্য নয়, শরীর ও মনের সামগ্রিক সুস্থতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন রাতে গড়ে ৮ ঘণ্টা ঘুম মনোযোগ, কাজের দক্ষতা, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ও মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এমনকি খেলাধুলার পারফরম্যান্সেও ঘুমের বড় ভূমিকা আছে। ২০২০ সালে জার্নাল অব আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজিতে (জেএসিসি) প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, খুব কম বা খুব বেশি ঘুম—দুটোই হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। বিস্ময়কর বিষয় হলো, যাঁদের স্বাস্থ্যের অন্য কোনো সমস্যা নেই, তাঁদের ক্ষেত্রেও শুধু ঘুমের গন্ডগোল থেকে এই ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। তাই হৃৎস্বাস্থ্য রক্ষা করতে চাইলে ঘুমকে গুরুত্ব দিতে হবে।

৬ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমালে কী হয়

৬ ঘণ্টার কম ঘুমান, তাঁদের মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি প্রায় ২০ শতাংশ বেশি
ছবি: পেক্সেলস

জার্নাল অব আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি (জেএসিসি) প্রকাশিত ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪ লাখ ৬১ হাজার ৩৪৭ জন অংশগ্রহণকারীর ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা প্রতি রাতে গড়ে ৬ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমান, তাঁদের তুলনায় যাঁরা ৬ ঘণ্টার কম ঘুমান, তাঁদের মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। আর যাঁরা ৯ ঘণ্টার বেশি ঘুমান, তাঁদের ঝুঁকি প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো বোল্ডারের ইন্টিগ্রেটিভ ফিজিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং গবেষণার জ্যেষ্ঠ লেখক সেলিন ভেটার বলেন, ‘জীবনধারা উন্নত হবে কি হবে না, তা নির্ভর করে আপনি বেশি না কম ঘুমাচ্ছেন। কারণ, ঘুমের ব্যাপ্তিকাল হৃৎস্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাসগত বিষয়। আর এটি সবার জন্য প্রযোজ্য।’ তাই দেখা যাচ্ছে, হৃদ্‌রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলেও প্রতি রাতে ৬ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমালে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে।

ঘুম কম হলে বেড়ে যায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি

যাঁরা দিনে ৬ ঘণ্টার কম ঘুমান, তাঁদের হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল স্লিপ মেডিসিন’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমের সময়কাল ও মান—দুটোই হৃদ্‌রোগের ঝুঁকির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সী ৬০ হাজারের বেশি মানুষকে নিয়ে করা এই গবেষণায় দেখা যায়, যাঁরা দিনে ৬ ঘণ্টার কম ঘুমান, তাঁদের হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আবার যাঁদের ঘুমের মান খারাপ, যেমন ঘুমাতে সমস্যা হয়, বেশি স্বপ্ন দেখেন বা ঘুমের ওষুধ নিতে হয়, তাঁদের ঝুঁকিও বেশি। বিশেষ করে যাঁদের ঘুমের সময় ও গুণমান দুটোই খারাপ, তাঁদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে। ফলে হৃৎস্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে শুধু কতক্ষণ ঘুমাচ্ছেন, তা-ই নয়, ঘুম কতটা প্রশান্তিময় হচ্ছে, সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

বেশি ঘুমও বিপদ ডেকে আনতে পারে

বেশি ঘুমও বিপদ ডেকে আনতে পারে

অন্যদিকে ‘সায়েন্স ডাইরেক্টরি’তে প্রকাশিত ‘স্লিপ রিভিউ মেডিসিন’-এ ৫০ লাখের বেশি মানুষের তথ্য নিয়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘুমান, তাঁদের মৃত্যুর আশঙ্কা ও কিছু রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। যেমন মৃত্যুহার ৩৯ শতাংশ বেশি, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ২৬ শতাংশ বেশি, হৃদ্‌রোগ ২৫ শতাংশ বেশি, স্ট্রোক ৪৬ শতাংশ বেশি, করোনারি হৃদ্‌রোগ ২৪ শতাংশ বেশি। তবে উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে স্পষ্ট কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে যে ঘুম যত বাড়ে, হৃদ্‌রোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকিও তত বাড়ে।

এই গবেষণা প্রমাণ করে যে ৬ থেকে ৯ ঘণ্টার মধ্যেই ঘুম সীমিত রাখা স্বাস্থ্যকর। কারণ, এর কম বা বেশি ঘুমে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ে।

ঘুম না হলে শরীরে কী ঘটে

যথেষ্ট ঘুম না হলে মানসিক চাপ দেখা দিতে পারে

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল স্কুল অব মেডিসিনের ঘুমবিশেষজ্ঞ ও পালমোনোলজিস্ট মেয়ার ক্রাইগার জানিয়েছেন, যথেষ্ট ঘুম না হলে মেটাবলিক সমস্যা যেমন স্থূলতা, প্রদাহ, মানসিক চাপ, রোগ প্রতিরোধে দুর্বলতা এবং রক্তনালির প্রাচীরে অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে। এসব পরিবর্তন হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে পারে। সব মিলিয়ে যাঁদের হৃদ্‌রোগের জেনেটিক ঝুঁকি আছে, তাঁদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায় কম ঘুম হলে। তাই ঘুমকে প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় অগ্রাধিকার দিতেই হবে।

সবশেষে

নর্থওয়েল হেলথের অন্তর্ভুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ শোর ইউনিভার্সিটি হসপিটালের কার্ডিওভাসকুলার হেলথ ও লিপিডোলজি বিভাগের পরিচালক গাই মিন্টজ বলেন, হার্ট হলো এমন এক মোটর, যেটা ২৪ ঘণ্টা কাজ করে। হার্টেরও বিশ্রামের প্রয়োজন। একটি গাড়ির ইঞ্জিন যেমন ২৪/৭ ঘণ্টা চললে তা জ্বলে যাবে, তেমনি হার্টও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

তাই পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে এবং অনিদ্রা বা উদ্বেগজনিত ঘুমের সমস্যা থাকলে অবশ্যই ঘুমবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

সূত্র: হেলথ লাইন