বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস প্রতিবছরের ২৮ জুলাই পালিত হয়। দিবসটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব সদস্যরাষ্ট্র এবং ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্সের ১১৫টি সদস্যদেশের ৪০০টির বেশি সংগঠন পালন করছে। দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হলো হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রতিরোধ, পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা।

দিবসটি উপলক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ বাণী দিয়েছেন, যেখানে তিনি সবাইকে হেপাটাইটিস নির্মূলে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের লক্ষ্য পূরণ হয়। দিবসটি উপলক্ষে ন্যাশনাল লিভার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ দেশব্যাপী জনসচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য ‘চলুন সহজভাবে বুঝি’ (লেটস ব্রেক ইট ডাউন)। হেপাটাইটিস প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের পথে যেসব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক বাধা রয়েছে, তা দূর করতে হবে। হেপাটাইটিসের ভয়াবহতা, প্রতিরোধের উপায়, পরীক্ষা ও চিকিৎসা সম্পর্কে সবার জানা জরুরি। এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ, যদি সঠিক সময়ে পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।
হেপাটাইটিস কী
হেপাটাইটিস হলো লিভারের প্রদাহ, যা সাধারণত ভাইরাসের কারণে হয়। এর মধ্যে রয়েছে হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাস। এসব ভাইরাস তাৎক্ষণিক (অ্যাকিউট) ও দীর্ঘস্থায়ী (ক্রনিক) লিভার রোগের কারণ হতে পারে, যার পরিণতিতে লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যানসার ও শেষ পর্যন্ত লিভার ফেইলিউর হতে পারে। বর্তমানে হেপাটাইটিস বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাণঘাতী সংক্রামক ভাইরাস। প্রতিবছর ২২ লাখের বেশি মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হন এবং ১০ লাখের মানুষ হেপাটাইটিসজনিত জটিলতায় মারা যান।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
• হেপাটাইটিস এ এবং ই ভাইরাস দূষিত খাদ্য ও পানি থেকে ছড়ায়। এগুলো তাৎক্ষণিক লিভার সংক্রমণের কারণ হতে পারে। এমনকি ফালমিন্যান্ট হেপাটাইটিস হয়ে লিভার ফেইলিউরও হতে পারে।
• বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত প্রায় ৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং হেপাটাইটিস সি-তে প্রায় শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত।
• অকাল্ট (লুকায়িত) হেপাটাইটিস বি একটি বড় উদ্বেগ, যেখানে ব্যক্তি হেপাটাইটিস বি ভাইরাস বহন করে কিন্তু এইচবিএসএজি পরীক্ষায় ধরা পড়ে না, তা থেকে নীরবে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসার হতে পারে।
• দেশে ৯০ লাখ থেকে ১ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসে আক্রান্ত।
• প্রতিবছর ২০ হাজারের বেশি মানুষ হেপাটাইটিসের কারণে মারা যান।
• লিভার ক্যানসার বাংলাদেশে ক্যানসারে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। হেপাটাইটিস বি এবং সি লিভার ক্যানসারের মূল কারণ।
প্রতিরোধের উপায়
হেপাটাইটিস এ এবং ই প্রতিরোধের উপায়
• নিরাপদ পানি ও খাদ্য নিশ্চিত করা।
• নিরাপদ স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা।
• হেপাটাইটিস এ ভ্যাকসিন গ্রহণ করা।
• গর্ভবতী নারীদের হেপাটাইটিস ই বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ, তাই তাঁদের জন্য বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন।
হেপাটাইটিস বি এবং সি প্রতিরোধ
ভাইরাস দুটি সংক্রামিত রক্ত ও শরীরের তরলের মাধ্যমে ছড়ায়।
প্রতিরোধে যা করতে হবে—
• রক্ত সঞ্চালনের আগে হেপাটাইটিস বি, সি এবং হেপাটাইটিস বি কোর অ্যান্টিবডি (অ্যান্টি-এইচবিসি টোটাল) পরীক্ষা করা।
• একই সুচ ও সিরিঞ্জ পুনর্ব্যবহার নিষিদ্ধ।
• ব্যক্তিগত জিনিস (দাঁতের ব্রাশ, রেজর) অন্যের সঙ্গে ব্যবহার না করা।
• সেলুন, ডেন্টাল ক্লিনিক, অপারেশন, ট্যাটু বা কানের ফুটো করার সময় স্টেরিলাইজড সরঞ্জামের ব্যবহার।
• নিরাপদ যৌন আচরণ।
• আক্রান্ত ব্যক্তি যেন রক্ত বা অঙ্গ দান না করেন।
নিয়ন্ত্রণের কৌশল
• সর্বজনীন পরীক্ষা ও ভ্যাকসিনেশন।
• পরিবারের কোনো সদস্যের হেপাটাইটিস বি এবং সি নির্ণীত হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের এই দুই ভাইরাসের পরীক্ষা করা এবং প্রতিরোধে হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া।
• গর্ভকালীন হেপাটাইটিস বি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক।
• নবজাতকের জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভ্যাকসিন ও প্রয়োজনে ইমিউনোগ্লোবিউলিন (এইচবিআইজি) প্রদান।
• চিকিৎসাব্যবস্থায় নিরাপদ চর্চা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ।
• হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসের ওষুধের মূল্য সহজলভ্য করা।
• চাকরি, শিক্ষা ও সামাজিক পরিসরে কুসংস্কার ও বৈষম্য দূর করা।
• বিজ্ঞানভিত্তিক সচেতনতা ও তথ্য প্রচার।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণ
• দেশের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। গ্রামাঞ্চলে সচেতনতা ও চিকিৎসাসেবার ঘাটতি রয়েছে।
• ৬২ শতাংশ গর্ভবতী নারী গ্রামে, যাঁদের কাছে পরীক্ষা ও ভ্যাকসিনেশন এখনো পৌঁছায়নি।
• কুসংস্কার, ভুল ধারণা ও পরিষেবার অভাবে তাঁরা চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন।
• স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ। যাতে গ্রামীণ জনগণ হেপাটাইটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসার আওতায় আসতে পারেন।
বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূলের লক্ষ্যে
• সব নবজাতককে বার্থডোজের আওতায় আনা।
• সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
• সচেতনতা, স্ক্রিনিং, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা—সবকিছু সহজলভ্য করতে হবে, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য।
• জাতীয় ভাইরাল হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে জাতীয় নীতিমালা ও কর্মসূচি গ্রহণ।
আসুন হেপাটাইটিস নিয়ন্ত্রণে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে হেপাটাইটিসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি। একটি হেপাটাইটিসমুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যাশায়।